অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো

অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো – বাংলা তথা ভারতের নারী সমাজ অসহযোগ আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই প্রথম সমাজের সর্বস্তরের নারীরা ব্যাপক হারে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। সুদূর পল্লী-অঞ্চলের মেয়েদের মধ্যেও এই আন্দোলন সাড়া তোলে।
 
তো চলুন আজকের মূল বিষয় অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো পড়ে নেওয়া যাক।

অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো

অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো

অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা

রাওলাট আইন (১৯১৯ খ্রিঃ) ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের (১৯১৯ খ্রিঃ) প্রতিবাদে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। গান্ধিজির ডাকে হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শ্রমিক-কৃষক- সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। বাংলাদেশে এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশের ওপর। বিলাসী ব্যারিস্টার আইন ব্যবসা পরিত্যাগ করে জনগণের সেবকে পরিণত হন এবং দেশের জন্য সর্বত্যাগী হওয়ার সুবাদে ‘দেশবন্ধু’ উপাধি লাভ করেন। 
  • বাংলা তথা ভারতের নারী সমাজ এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই প্রথম সমাজের সর্বস্তরের নারীরা ব্যাপক হারে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। সুদূর পল্লী-অঞ্চলের মেয়েদের মধ্যেও এই আন্দোলন সাড়া তোলে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও তাঁর পত্নী বাসন্তী দেবী ব্যাপকভাবে বাংলার বিভিন্ন জেলা পরিভ্রমণ করে অসহযোগ আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। বাসন্তী দেবীর অনুপ্রেরণায় মহিলারা ‘তিলক-স্বরাজ্য ফান্ড’-এ ব্যাপকভাবে গয়না ও টাকাকড়ি দান করতে থাকেন। ১৯২১ সালের ১৭ নভেম্বর ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ 7 বা ইংল্যান্ডের যুবরাজ ভারত পরিদর্শনের জন্য বোম্বাই-এ পদার্পণ করলে সারা ভারতব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। বোম্বাই-এ এক হাজার মহিলা বিক্ষোভ দেখায়। কলকাতায় এই ধর্মঘট ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। এর উত্তরে সরকার ১৮ নভেম্বর সকল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে বে-আইনী এবং সভা-সমিতিকে রাজদ্রোহমূলক বলে ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে ৭ ডিসেম্বর বাসন্তী দেবী, দেশবন্ধু-ভগিনী উর্মিলা দেবী এবং ‘নারী কর্মমন্দির’-এর কর্মী সুনীতি দেবী-সহ বেশ কিছু মহিলা কলকাতার বড়বাজারে খদ্দর বিক্রির জন্য রাস্তায় নামলে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। অহিংস রাজনৈতিক আন্দোলনে এটাই প্রথম নারী গ্রেপ্তারের ঘটনা। এর প্রতিবাদে বিপুল সংখ্যক জনতা থানা ঘেরাও করে- সারা বাংলা ক্ষোভে-রোষে ফেটে পড়ে। নারীসমাজে প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত রাত্রি ১১টার সময় সরকার তাঁদের মুক্তি দেয়। এই ঘটনার তিনদিন পর ১০ই ডিসেম্বর দেশবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর ফলে বাংলার নেতৃত্ব বাসন্তী দেবীর উপর আরোপিত হয়। তিনি দেশবন্ধুর ‘বাংলার কথা’ সম্পাদনা করতে থাকেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস’-এর অধিবেশনে তিনি সভানেত্রীত্ব করেন এবং দেশবন্ধুর নতুন কর্মপদ্ধতির ইঙ্গিত দেন। এই অধিবেশনে নারীসমাজের উপস্থিতি অন্যান্য সব সম্মেলনকে ম্লান করে দেয়। সংবাদপত্রের প্রশ্ন: “এ ঘটনার কারণ কি একজন মহিলার সভাপতিত্ব গ্রহণ, না বাঙালি নারীর রাজনৈতিক জাগরণ?” (দৈনিক বসুমতী, ২৪ এপ্রিল, ১৯২২)। 
  • বাসন্তী দেবী যখন সভা-সমিতির মাধ্যমে নারীসমাজকে উদ্বুদ্ধ করছেন, তখন দেশবন্ধু-ভগিনী উর্মিলা দেবী (১৯০০-১৯৫৬ খ্রি.) মহিলাদের মধ্যে স্বরাজের মূলমন্ত্র প্রচার এবং চরকা ও খাদিকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ‘নারী কর্মমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। ভবানীপুরে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটিতে বহু অনাথা মেয়ে আশ্রয় পেয়েছিল। সেখানে তাঁত, চরকা প্রভৃতি শিল্পশিক্ষা দেওয়া ছাড়াও মেয়েদের আইন অমান্য ও সত্যাগ্রহে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করা হত। কুমিল্লার রাজনৈতিক কর্মী বসন্তকুমার মজুমদারের পত্নী হেমপ্রভা মজুমদার তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। ঊর্মিলা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশের লাঠি অগ্রাহ্য করে তিনি কলকাতার নানাস্থানে সভাসমিতি পরিচালনা করতে থাকেন। 
  • এই আন্দোলন প্রসঙ্গে মোহনী দেবী-র (১৮৬৩-১৯৫৫ খ্রিঃ) কথা বলতে হয়। তিনি বিশিষ্ট পদস্থ সরকারি কর্মী তারকচন্দ্র দাশগুপ্তের পত্নী এবং বিশিষ্ট শ্রমিক নেত্রী ড. প্রভাবতী দাশগুপ্তার মাতা। স্বামীর মৃত্যুর পর (১৯২০ খ্রিঃ) তিনি অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নগ্নপদে বাড়ি বাড়ি খদ্দর বিক্রি, সভা সমিতিতে বক্তৃতা দান এবং মফস্বলে স্বরাজের বার্তা প্রচার কোনোটাতেই তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। 
  • মফস্বলে এই আন্দোলন যথেষ্ট ঢেউ তুলেছিল। ঢাকার গেন্ডারিয়া-য় আশালতা সেন (১৮৯৪-১৯৭২ খ্রিঃ) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে নিজের শ্বশুর বাড়িতে ‘শিল্পাশ্রম’নামে মেয়েদের জন্য একটি বয়নকেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে মেয়েরা নিজেরা খদ্দর বুনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেগুলি বিক্রি করতেন। এখানে তৈরি শিল্প সামগ্রি বিক্রির জন্য প্রতিবছর শিল্পমেলা সংগঠিত হত। গান্ধিজির বাণী ও জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ‘গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি’ গড়ে তোলেন। 
  • মেদিনীপুরের কাঁথিতে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে ইউনিয়ন বোর্ড বর্জনের উদ্দেশ্যে কর বন্ধ আন্দোলন শুরু হলে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। 
  • ১৯২২ সালে চট্টগ্রামের চাঁদপুরে ‘কুলি’ নিগ্রহ ও স্টিমার ধর্মঘটের সময় ‘দেশপ্রিয়’ যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং তাঁর বিদেশিনী পত্নী শ্রীমতী নেলী সেনগুপ্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় বসন্তকুমার মজুমদার-পত্নী হেমপ্রভা মজুমদারও ধর্মঘটকারী এবং আসাম-প্রত্যাগত বাগানের ‘কুলি’-দের সাহায্যের জন্য ছয়মাস গোয়ালন্দে অবস্থান করেন। 
  • বাংলার বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু মহিলা নেত্রীর আবির্ভাব হয়। বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে তাঁরা মেয়েদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজে তাঁদের যুক্ত করেন। এব্যাপারে সিলেটের সরলাবালা দেব, বালুরঘাটের প্রভা চট্টোপাধ্যায়, ভোলার সরযুবালা সেন, বরিশালের ইন্দুমতী গুহঠাকুরতা, নোয়াখালির সুশীলা মিত্র, খুলনার স্নেহশীলা চৌধুরী, বর্ধমানের সুরমা মুখোপাধ্যায়, সিরাজগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী, ময়মনসিংহের উষা গুহ, বরিশালের প্রফুল্ল কুমারী বসু প্রমুখের নাম অতি উল্লেখযোগ্য। পতিতারাও এই আন্দোলনে সামিল হন। ১৯২৩ সালে গান্ধিজি বরিশালে এলে প্রায় ৩০০ পতিতা তাঁর সভায় যোগদান করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের পেশা ত্যাগ করে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত চরকা ও খাদি প্রতিষ্ঠান ‘কুটির শিল্পাশ্রম’-এ যোগদান করেন।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment