অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও

অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও – ১৯২০-২২ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেবলমাত্র শহরের মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরাই নয়- শ্রমিক, কৃষক, মজুর, নারী- পুরুষ-সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এই আন্দোলন যথার্থ গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
 
তো চলুন আজকের মূল বিষয় অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও পড়ে নেওয়া যাক।

অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও

অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও
অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও

অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন

১৯২০-২২ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেবলমাত্র শহরের মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরাই নয়- শ্রমিক, কৃষক, মজুর, নারী- পুরুষ-সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এই আন্দোলন যথার্থ গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এই আন্দোলনে ভারতের কৃষক সম্প্রদায় এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে এবং কৃষক আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ধারার সঙ্গে মিশে যায়। পূর্ববর্তী যুগের কৃষক আন্দোলনগুলি মূলত কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এগুলির সঙ্গে সমাজের অন্যান্য স্তরের মানুষের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সমাজের অন্যান্য স্তরের আদর্শবাদী মানুষরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেন। মদনমোহন মালব্য, গৌরীশঙ্কর মিশ্র, ইন্দ্রনারায়ণ দ্বিবেদী, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল এবং কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এইভাবে কৃষক আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশে পরিণত হয়।

রাজস্থান

নানা ধরনের উপ-কর এবং সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে রাজস্থানে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়।
  • মেবারের বিজোলিয়া অঞ্চলে বিজয় সিং পথিক ও মানিকলাল বর্মার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তাদের দাবি কিছুটা আদায়ে সক্ষম হয়। 
  • ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল তেজওয়াত মেবারের ভীল উপজাতিদের সংগঠিত করতে থাকেন। 
  • মারোয়াড়-এ জয়নারায়ণ ব্যাস-এর নেতৃত্বে কৃষকরা কর বন্ধ আন্দোলন শুরু করে। 
  • আলোয়ারের বিক্ষুব্ধ কৃষকরা পার্শ্ববর্তী গুরগাঁও জেলার একটি থানা আক্রমণ করে। উদয়পুরের মহারাণার বিরুদ্ধে এই সব আন্দোলন সফল হয়নি। জাতীয় কংগ্রেস মেবার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করলে কংগ্রেস নেতা মদনমোহন মালব্য বাধা দেন। তিনি বলেন যে, উদয়পুরের মহারাণা তাঁর বন্ধু এবং তিনি মহারাণাকে বুঝিয়ে কৃষকদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেবেন।

বিহার

১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর বিহারের দ্বারভাঙ্গা, মজঃফরপুর, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া ও মুঙ্গের জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দ্বারভাঙ্গা মহারাজার বিরুদ্ধে কৃষকদের বিদ্রোহ শুরু হয়। যুদ্ধজনিত কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিল। এ ছাড়া, রাজার কর্মচারী ও ছোটো জমিদাররা অন্যায়ভাবে তাদের কাছ থেকে নানা কর আদায় করত। এ সময় দ্বারভাঙ্গা-রাজ তাঁর খাস জমিতে গো-চারণ এবং জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ নিষিদ্ধ করলে কৃষকদের অসন্তোষ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের শেষে স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে কৃষকেরা মধুবনী মহকুমার নারার গ্রামে সমবেত হয়ে প্রথম বিক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা আমলাদের জুলুম ও নীচু জাতের কৃষকদের কাছ থেকে ঘি, তেল প্রভৃতি আদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং ফসলের পরিবর্তে নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদানের দাবি জানায়। প্রথমে এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও দ্বারভাঙ্গা মহারাজের প্ররোচনায় কয়েকটি হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটে। কৃষকরাও বহু জায়গায় হাট লুঠ করতে থাকে। মজঃফরপুরের সীতামারী মহকুমা ছিল ঝড়ের কেন্দ্র। এখানে কৃষকরা সকল প্রকার কর বন্ধ করে দেয়।

বাংলা

অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার কৃষকরাও অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-জনিত করভার ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং জমিদারি শোষণ বাংলার কৃষকদের সর্বনাশের শেষ সীমায় পৌঁছে দেয়। 
  • ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে কাঁথি ও তমলুক মহকুমায় ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই দুই মহকুমার আপামর জনসাধারণ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের চাপে সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। 
  • ১৯২১-২২ সালে পাবনা, বগুড়া ও বীরভূমে সরকারি জমি জরিপের কাজে বাধা দেওয়া হয়। বীরভূমে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বিশিষ্ট গান্ধীবাদী নেতা, কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজের ইংরেজির প্রবাদ-প্রতীম অধ্যাপক জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। 
  • রাজশাহীতে নীলচাষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সোমেশ্বর প্রসাদ চৌধুরী। 
  • কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরে মুসলিম কৃষকদের অংশগ্রহণে অসহযোগ আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। 
  • বীরভূম, বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রাম-এর সাঁওতালদের ভেতর তীব্র উন্মাদনা দেখা দেয়। 
  • ঝাড়গ্রাম-এর সাঁওতালরা কংগ্রেস নেতা শৈলজানন্দ সেনের নেতৃত্বে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং হাট ও জমিদারের জঙ্গল লুঠ করতে থাকে। 
  • চট্টগ্রামে জঙ্গল লুঠ শুরু হয়। 
  • ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জলপাইগুড়িতে গান্ধী-টুপি পরিহিত সাঁওতালরা পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের ধারণা ছিল যে, গান্ধী-টুপি পরলে পুলিশের গুলি তাদের গায়ে লাগবে না। 
  • নীলফমারিতে মুসলিম কৃষকরা জনৈক ‘গান্ধী দারোগা’-র অধীনে একটি ‘স্বরাজ থানা’ পত্তন করে। 

উত্তরপ্রদেশ

অসহযোগ আন্দোলনের সময় যুক্তপ্রদেশ বা বর্তমান উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অসহযোগ আন্দোলনের বহু পূর্ব থেকেই এখানে কৃষক আন্দোলন শুরু হয় এবং এই আন্দোলন ছিল মূলত কৃষকদেরই আন্দোলন। এর সঙ্গে অন্য কোনো রাজনীতির সম্পর্ক ছিল না। কৃষকরা মূলত বেগার প্রথা, জমি বেদখল, ‘হাতিওয়ানা’ (জমিদারের হাতি চড়ার খরচ), ‘মোটরওয়ানা’ (মোটর চড়ার খরচ), নজরানা দেওয়া এবং বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক অনাচারের বিরুদ্ধে নিজেরাই সংঘবদ্ধ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। ড. জ্ঞান পাণ্ডে জানাচ্ছেন যে, এই অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক বিদ্রোহই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং বাইরের নেতাদের হস্তক্ষেপ ছিল প্রান্তিক এবং পরবর্তী সময়ের।’ যুক্ত প্রদেশের হোমরুল ও কংগ্রেস নেতারা এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন।

বেগার প্রথা, জমি বেদখল, বলপূর্বক অতিরিক্ত কর আদায় ও অন্যান্য সামন্ততান্ত্রিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতাপগড় ও রায়বেরিলি জেলায় দু’জন স্থানীয় কৃষক নেতার অধীনে কৃষকরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। এ সময় বাবা রামচন্দ্র নামে এক সন্ন্যাসীর আগমনে কৃষক আন্দোলনে গতিবেগের সঞ্চার হয়। ১৯২০ সালের জুন মাসে তিনি এলাহাবাদে গিয়ে গৌরীশংকর মিশ্র ও জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর ফলে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জওহরলালের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং তিনি যুক্তপ্রদেশের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে পরিক্রমা করেন। বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কৃষকরা খাজনা বন্ধ আন্দোলন শুরু করে এবং অত্যাচারী জমিদার-তালুকদারদের ‘সামাজিক বয়কট’ করা শুরু হয়। তাঁর আন্দোলন জমিদারদের সন্ত্রস্ত করে তোলে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট বাবা রামচন্দ্র ও তাঁর ৩২ জন কিষাণ অনুগামীকে মিথ্যা চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। প্রায় ৪৫ হাজার কৃষক তাঁদের মুক্তির দাবিতে প্রতাপগড় জেল ঘেরাও করে। তাদের বুঝিয়ে ফেরৎ পাঠানো হয় এবং গোলমালের আশঙ্কায় সরকার বাবা রামচন্দ্রকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে জওহরলালের প্রভাবে বাবা রামচন্দ্র প্রতাপগড়ে ‘অযোধ্যা কিষাণ সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। অচিরেই এর ৩৩০টি শাখা স্থাপিত হয়। ১৯২১ সাল থেকে এই আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ কৃষকরা রায়বেরিলি, প্রতাপগড়, ফৈজাবাদ ও সুলতানপুরে জমিদার- তালুকদারদের ঘর-বাড়ি, খামার ও শস্যক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ চালায়। তারা সরকারি প্রশাসনকে অস্বীকার করে নিজেরাই প্রশাসন গড়ে তোলে। আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠলে কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ সরে দাঁড়ান। এর ফলে সরকার নিষ্ঠুর দমননীতি অবলম্বন করে আন্দোলন ভেঙ্গে দেয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ‘অযোধ্যা খাজনা আইন’ (Oudh Rent Act) পাশ করে সরকার কৃষকদের কিছুটা সুবিধা দেবার চেষ্টা করে।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষ এবং ১৯২২-এর সূচনায় সামন্ততান্ত্রিক অনাচারের বিরুদ্ধে যুক্তপ্রদেশের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ প্রভৃতি অঞ্চলে এক কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহ ‘একা’ বা ‘একতা’ বিদ্রোহ বা আন্দোলন নামে খ্যাত। আন্দোলন চলাকালে যে-কোনো অবস্থায় কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেন-তাই এই আন্দোলনের নাম ‘একা’ বা ‘একতা’ আন্দোলন। আন্দোলনের সূচনা-পর্বে কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ এর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মাদারী পাশী নামে অনুন্নত সম্প্রদায়ের এক নেতাই ছিলেন এই আন্দোলনের মূল শক্তি। তাঁর আহ্বানে অনুন্নত সম্প্রদায়ের কৃষকরা দলে দলে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মন্ত্রপাঠ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকরা শপথ নিত যে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত খাজনা ছাড়া তারা বেশি কিছু দেবে না, জমি থেকে উচ্ছেদ করলেও তারা জমি ছাড়বে না, রসিদ ছাড়া খাজনা দেবে না, খাজনা দেবে নগদ টাকায়- শস্যের মাধ্যমে নয়, জমিদারের জমিতে বেগার খাটবে না, গ্রাম্য বিরোধের মীমাংসা হবে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এবং সর্বক্ষেত্রে কৃষকরা ঐক্য বজায় রাখবে। ক্রমে এই আন্দোলন কংগ্রেস নেতাদের হাত থেকে বেরিয়ে যায় এবং তা হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। জমিদার ও তালুকদারদের ঘর-বাড়ি ও খামার আক্রান্ত হয় এবং কুমায়ুন অঞ্চলের হাজার হাজার মাইল সংরক্ষিত অরণ্যে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আসরফ সিদ্দিকি-র মতে, যুক্তপ্রদেশে ‘সামাজিক দস্যুতা’ (Social bandity) শুরু হয়। প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে এই আন্দোলন দমন করা হয়। মাদারী পাশীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দক্ষিণ ভারত

  • অন্ধ্রের গুন্টুর জেলার পালনাদ তালুক ও কুড্ডাপ্পার রায়চোটি তালুকের উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত গরিব চাষিরা তাদের অরণ্যের অধিকার রক্ষার জন্য অরণ্য সত্যাগ্রহ গড়ে তোলে। তারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং তাদের আন্দোলনের ফলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। পালনাদের কিছু অধিবাসী স্বরাজ ঘোষণা করে। বহু স্থানে পুলিশের ওপরেই আক্রমণ হয়। এই আন্দোলনে নেতা ছিলেন কংগ্রেসের কোনাডা ভেঙ্কটাপ্পাইয়া। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হলে এই আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৩-২৪ সালে তাঞ্জোরে রাজস্ব বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলনে নামে। অস্ত্রের গুন্টুর জেলার অধ্যাপক এন. জি. রঙ্গ ‘রায়ত সমিতি’ (১৯২৩ খ্রিঃ) গড়ে তোলেন। 
  • অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও ভয়াবহ কৃষক আন্দোলনটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সুদূর দক্ষিণে কেরালার মালাবার অঞ্চলে, যা মোপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। দীর্ঘদিনের অন্যায় ও অযৌক্তিক সামন্ততান্ত্রিক শোষণ তো ছিলই-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খলিফাকে হৃতরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ধর্মীয় উন্মাদনা এবং ইংরেজ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ। এই তিন আন্দোলনের উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠে মোপলা বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় পর্যবসিত হলেও এর মূল চরিত্রটি ছিল সামন্ততন্ত্র-বিরোধী। মুসলিম মোপলারা হিন্দু জমিদারদের হাতে নির্যাতিত হয়ে জমিদার-বিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। তারা ৬০০ হিন্দুকে নিহত এবং ২৫০০ হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করে। বিদ্রোহীরা জমিদারদের বাড়ি, কাছারি, থানা ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরের ওপর আক্রমণ চালায়। মালাবারের প্রধান শহরগুলি ব্রিটিশদের হাতে থাকলেও তিন মাস গ্রামাঞ্চলের পূর্ণ আধিপত্য ছিল বিদ্রোহীদের হাতে। সরকার কঠোর হস্তে এই আন্দোলন দমন করে এবং ২৩৩৭ জন মোপলা নিহত হয়। 
  • এই সময় অন্দ্রের গোদাবরী উপত্যকায় বসবাসকারী রুম্পা উপজাতিদের বিদ্রোহ (১৯২২-২৪ খ্রিঃ) সরকারকে যথেষ্ট বিব্রত করে। নানা ধরনের মহাজনি শোষণে জর্জরিত বুম্পারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুব্ধ ছিল। মহাজনশ্রেণি নানা অছিলায় তাদের জমিগুলি কেড়ে নেয় ও তাদের ঋণভারে জর্জরিত করে। ইংরেজ সরকার আইন করে রুম্পা উপজাতিদের বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ এবং বনে গোচরণ নিষিদ্ধ করে। এ সময় আল্লুরী সীতারামা রাজু নামে গান্ধী-অনুরাগী এক তরুণের নেতৃত্বে আদিবাসী রুম্পারা ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাঁর ডাকে হাজার হাজার আদিবাসী কৃষক গণ-সত্যাগ্রহে সামিল হয়। অচিরেই তা রূপান্তরিত হয় গণ-বিদ্রোহে। ২৫০০ মাইল আঙুরী সীতারামা রাজু এলাকা জুড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চলে। সরকার বল্লাহীন নিষ্ঠুরতার পথ ধরে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়। এই আন্দোলন দমন করতে মাদ্রাজ সরকারকে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হয়।

অসহযোগ আন্দোলনের পর (১৯২৪-২৮)

অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ হওয়ার পর কৃষক আন্দোলনে কিছুটা ভাঁটা পড়লেও, তা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। 
  • বাংলায় স্বরাজ্য দলের নেতৃবৃন্দ কৃষকদের সংগঠিত করতে ব্যর্থ হন। ভূমিহীন কৃষক ও ভাগচাষিদের স্বার্থে তাঁরা কিছুই করতে পারেননি বরং এই পর্বে কৃষক আন্দোলনগুলি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ ধারণ করে। ১৯২৮-এ বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব সংশোধনী বিলের ওপর আলোচনাকালে তাঁরা ভূমিহীন কৃষক ও ভাগচাষিদের স্বার্থ রক্ষা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। 
  • ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনকে’ কেন্দ্র করে আক্রাম খাঁ, আবদুর রহিম ও ফজলুল হক ‘প্রজা পার্টি’ গঠন করেন। পরে নাম পরিবর্তন করে এই দলের নাম হয় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’। বাংলার মুসলিম কৃষকদের ওপর এই দলের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। 
  • বিহারে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। তিনি ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিহার প্রাদেশিক কিষাণ সভা’। কংগ্রেস নেতা শ্রীকৃষ্ণ সিংহ ছিলেন এই সংগঠনের প্রথম সম্পাদক। তাঁর অপর দুই বিশিষ্ট সহকর্মী ছিলেন বৌদ্ধশাস্ত্রে সুপণ্ডিত কৃষক নেতা রাহুল সংকৃত্যায়ন ও কারিয়ানন্দ শর্মা। পরে এঁরা দুজনেই কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হন। 
  • পাঞ্জাবে ফজল-ই-হুসেন-এর নেতৃত্বে ‘ইউনিয়ানিস্ট দল’ মহাজনি শোষণের হাত থেকে দরিদ্র কৃষকদের রক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলে। 
  • ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে আকালি নেতা খড়ক সিং ‘পাঞ্জাব রিয়াস্তি প্রজামণ্ডল’ গঠন করে পাতিয়ালার মহারাজার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। ১৯২৬ সালে পাতিয়ালার মহারাজ ভূমি রাজস্বের হার ১৯ শতাংশ – বাড়িয়ে দেন। এ ছাড়া, মহারাজের শিকারের জন্য সংরক্ষিত বনভূমি থেকে বন্যপশুরা প্রায়ই নানা ভাবে কৃষকদের ক্ষতি করত। এই সব কারণে পাতিয়ালার কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ‘রিয়াস্তি প্রজামণ্ডল’-এর বেশ কিছু নেতা অচিরেই মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। এঁদের মধ্যে জাগির সিং ও মাস্টার হরি সিং পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের কমিউনিস্ট কৃষক নেতা হিসাবে পরিচিত হন। 
  • উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস নেতারা কৃষকদের দাবির পক্ষে সহানুভূতিশীল মনোভাব গ্রহণ করেন। কংগ্রেস ও কংগ্রেস-সমর্থিত ‘উত্তরপ্রদেশ কিষাণ সভা’-র চাপে সরকার প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের এই সংশোধন দ্বারা জমিদারদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করা হয়। কংগ্রেস সরাসরি জমিদারদের আক্রমণ না করে জমিদারদের সমর্থন করার জন্য সরকারের সমালোচনা করার নীতি গ্রহণ করে।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment