আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার পথপ্রদর্শক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার খ্রিস্টান চার্চ ও পোপের ওপর কী প্রভাব ফেলেছিল

ভূমিকা
ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইউরোপে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ব্যাপকভাবে প্রসারলাভ করেছিল। আধুনিক জ্যোতির্বিদরা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা খ্রিস্টান চার্চ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত টলেমীয়-অ্যারিস্টট্রীয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণাকে যুক্তি ও প্রমাণ দ্বারা খণ্ডন করে সম্পূর্ণ ভুল বলে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন।
(1) চার্চের প্রতিক্রিয়া: দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠনের ধারণার বদলে এ যুগে সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মান্ডের ধারণার প্রসার খ্রিস্টান চার্চ ও পোপকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। যুক্তিহীন বিশ্বাস ও কুসংস্কার ত্যাগ করার জন্য বিজ্ঞানীদের আহ্বানকে চার্চ তথা পোপ নিজেদের অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করেন। জনসমাজে নিজেদের ধর্মীয় আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তাঁরা বিজ্ঞানীদের ‘স্পর্ধা’ চূর্ণ করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেন।
(2) জিওরদানো ব্রুনোর পরিণতি: কোপারনিকাসের মৃত্যুর দেড়শো বছর পর তাঁর সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মতবাদকে প্রচার ও দৃঢ় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হন ব্রুনো। তাঁর ‘অনন্ত মহাবিশ্ব ও বহুবিশ্ব নিয়ে’ গ্রন্থটি জনসমাজে আলোড়ন তৈরি করলে এবং বুনো চার্চের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করলে, ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে রোমান ইনক্যুইজিশন (ধর্ম আদালত)-এ ধর্মদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হয়। বিচারের নামে প্রহসনের পর তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ)।
(3) গ্যালিলিওর পরিণতি: একইভাবে ‘দৃশ্যমান জ্যোতির্বিদ্যার জনক’ গ্যালিলিও গ্যালিলেই-ও চার্চের কোপের মুখে পড়েন যখন তিনি তাঁর ‘Dialogue on the Two Systems of the World’ গ্রন্থে প্রাচীন টলেমীয় মহাবিশ্বের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে বইটি পোপকে (সপ্তম আরবান) উৎসর্গ করেন। ‘ইনক্যুইজিশন’ গ্যালিলিওকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাঁকে অন্যায়ভাবে চাপ দিয়ে নতিস্বীকার করিয়ে নেয় এই মর্মে যে গ্যালিলিওর মতবাদ ভুল, বাইবেলের বর্ণনাই বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠন সম্পর্কে ধ্রুবসত্য। গৃহবন্দি গ্যালিলিও শেষজীবনে অন্ধ হয়ে যান এবং নিঃসঙ্গ মৃত্যুবরণ করেন (১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ)।
(4) কেপলারের পরিণতি: জোহানেস কেপলারকেও তাঁর গ্রহ-নক্ষত্র-মহাবিশ্ব সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রচারের জন্য চার্চবিরোধী বলা হয় এবং তাঁর স্কুল ও গ্রন্থাগার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাঁর মা-কে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে ১৪ মাস কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। অপমানিত, বিধ্বস্ত কেপলার ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অনাড়ম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
মূল্যায়ন
এইভাবে একের পর এক সত্যদ্রষ্টা বিজ্ঞানীদের নির্মূল করে চার্চ ভেবেছিল বিজ্ঞানের অগ্রগতি রোধ করবে। পরিবর্তে বিজ্ঞানমনস্কতা আরও প্রসারিত হয় এবং চার্চের ভ্রান্ত প্রচারের অসাড়তা মানুষ বুঝতে পারে যা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর