![]() |
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের ভূমিকা আলোচনা করো। |
প্রথম অংশ
[১] কৃষি বিপ্লব: অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ব্রিটেন ছিল প্রধানত কৃষিপ্রধান দেশ এবং কৃষিকার্য অবৈজ্ঞানিক সনাতন পদ্ধতিতে চলত। কিন্তু তৃতীয় জর্জের রাজত্বের শেষভাগে নানাবিধ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হওয়ায় কৃষিকার্যের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে যা কৃষিবিপ্লব নামে পরিচিত এবং কৃষিপণ্যকে কেন্দ্র করেই শিল্পবিপ্লব রচিত হয়।
[২] সামুদ্রিক বাণিজ্যে উন্নতি ও মূলধনের প্রাচুর্য: অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামুদ্রিক বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং তা দু-ভাবে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল-প্রথমত, বাণিজ্য থেকে লব্ধ মুনাফা যন্ত্র আবিষ্কার ও কলকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সৃষ্টি করেছিল; দ্বিতীয়ত, সমুদ্রপারের বাজারগুলিতে ব্রিটিশ পণ্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং এই বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়।
[৩] খনিজ সম্পদ ও কাঁচামালের প্রাচুর্য: ইংল্যান্ডের খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য তার শিল্পায়নের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল, যেমন ইংল্যান্ডে কয়লা ও আকরিক লোহা যন্ত্রশিল্পের প্রসার সম্ভবপর করেছিল।
[৪] অনুকূল সামাজিক অবস্থা : ইংল্যান্ডের সামাজিক অবস্থাও শিল্পায়নের পক্ষে অনুকূল ছিল এবং ব্রিটেনের ভূম্যধিকারী অভিজাতরা উদ্বৃত্ত অর্থ শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশে তা কৃষি অর্থনীতির সীমিত পরিসরে আবদ্ধ ছিল।
[৫] শ্রমিকের সহজলভ্যতা: অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জমিচ্যুত বেকার কৃষকের সংখ্যাবৃদ্ধি পায় এবং গ্রামাঞ্চলের বেকার কৃষক ও দরিদ্র জনগণ কাজের খোঁজে শহরে এসেছিল। ফলে ইংল্যান্ডে শ্রমিকের সহজলভ্যতা ছিল, যা শিল্পবিপ্লবে গতি এনেছিল।
[৬] জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার প্রসার: শিল্পবিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটে। বৈজ্ঞানিক চেতনা আবিষ্কার করার চেতনা সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতি ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তিকে প্রয়োগ করার উৎসাহ জোগায়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, ইংল্যান্ড শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল সেগুলি থেকে ইউরোপের দেশগুলি কমবেশি বঞ্চিত ছিল। উপরন্তু ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের আগেই ঘটেছিল প্রারম্ভিক শিল্পায়ন (Industrialisation before Industrial Revolution) যা অন্যান্য দেশে সংঘটিত হয়নি।
দ্বিতীয় অংশ
[১] বস্ত্রশিল্প: ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংল্যান্ডে জন কে, জেমস হারগ্রিভস, স্যামুয়েল ক্রম্পটন, এডমন্ট কার্টরাইটের বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে সুতো কাটা এবং বোনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে।
[২] লৌহ শিল্প: দ্রুতগতিতে লোহা গলাবার জন্য এক বিশেষ ধরনের চুল্লি (Blust Furnace) আবিষ্কৃত হয় এবং এর ফলে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংল্যান্ডে লৌহযুগের সূচনা হয়।
[৩] খনি শিল্প: বৃহৎ শিল্প স্থাপনের জন্য কয়লার উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে খনির মধ্যেও বাষ্পচালিত যন্ত্রপাতির প্রবর্তন শুরু হয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে হামফ্রি ডেভির আবিষ্কৃত ‘নিরাপত্তা বাতির’ (Safety Lamp) ব্যবহারের ফলে খনিতে কাজ করা অপেক্ষাকৃত সহজ ও কম বিপজ্জনক হয়। এর ফলে কয়লার উত্তোলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
[৪] পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি: খনি থেকে শিল্পাঞ্চলে কয়লা পরিবহণের জন্য রেলগাড়ির প্রচলন শুরু হয় এবং ক্রমশ ব্রিটেনের শিল্পকেন্দ্রগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও খাল খনন করা হয়। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে জন ম্যাকাডাম পাথরকুচি ও পিচের দ্বারা মজবুত রাজপথ নির্মাণের কৌশল আবিষ্কার করেন। এছাড়া ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ব্রিটিশ স্টিমার ‘কমেট’ ক্লাইড নদীতে যাত্রা করেছিল।