ইউরোপে মুদ্রণ বিপ্লবের পটভূমি আলোচনা করো

ভূমিকা
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে আধুনিক মুদ্রণ-যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে শিক্ষা, ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা মুদ্রণ বিপ্লব নামে পরিচিত। তবে ইউরোপে ছাপা বই-এর বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধিকেই সাধারণভাবে মুদ্রণ বিপ্লব বলা হয়ে থাকে। যে বিষয়গুলি মুদ্রণ বিপ্লবের পটভূমি তৈরি করেছিল, সেগুলি হল-
(1) কাগজের ব্যবহার: মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে হাতে লেখা পুথি যা পার্চমেন্ট-এর ওপর লেখা হত, যা ছিল বেশ ব্যয়বহুল এবং সংখ্যায় খুবই অল্প। চিন থেকে আরবে এবং সেখান থেকে ইউরোপে কাগজ তৈরির পদ্ধতির প্রচলন ঘটলে ইউরোপে বই ছাপার কাগজ অনেক সহজ হয়।
(2) ছাপার ব্যয় হ্রাস: পার্চমেন্টে (পশুর চামড়া) বই ছাপানো ছিল অত্যন্ত সময়সাধ্য ও ব্যয়বহুল। কাগজের ব্যবহার ঘটলে ব্যয় অনেক কমে যায়। কারণ পার্চমেন্টের থেকে অনেক কম ছিল কাগজের দাম। ফলে স্বল্প সময়ে কম খরচে বেশি পরিমাণে বই ছাপা সম্ভব হয়।
(3) মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার: ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গ আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলে মুদ্রণশিল্পে যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে। জার্মানির মেইন্জ শহর থেকে শীঘ্রই জার্মানির অন্যান্য শহরে এবং তারপর ইউরোপের সর্বত্র মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা তৈরি হতে থাকে। ফলে বহুল পরিমাণে বহুসংখ্যক মানুষের হাতে পৌঁছে যায়।
(4) বইয়ের মানের উন্নতি: ধাতুশিল্পে অগ্রগতির ফলে সূক্ষ্ম ধাতব টাইপের ব্যবহার, তৈলাক্ত কালির ব্যবহার, প্রুফ সংশোধনের প্রথা প্রচলন ইত্যাদি ছাপা বই-এর মান উন্নত, নির্ভুল ও নিখুঁত করে।
(5) ছাপা বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি: উন্নত, সুদৃশ্য ও সস্তা হওয়ায় আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা বই-এর চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আগে যারা বেশি দামের কারণে বই কিনতে পারতেন না তারাও আগ্রহ সহকারে বই কিনতে উৎসুক হয়ে ওঠেন।
(6) নবজাগরণের প্রভাব: ইউরোপে নবজাগরণ প্রসূত অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহ, মানুষকে ব্যাপকভাবে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
(7) নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: পঞ্চদশ শতক নাগাদ নবজাগরণের আবহে অনেক নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এগুলি ইউরোপে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন হয় ছাপা বই। এইভাবে ছাপা বইয়ের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগের শেষ দিকে ইউরোপে কাগজের বহুল প্রচলন এবং মুদ্রণের ক্ষেত্রে নানা প্রযুক্তিগত উন্নতি মুদ্রণ বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছিল। মুদ্রণ বিপ্লবের ফলে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী অসংখ্য বইপত্র ছাপা হতে থাকে ফলে একদিকে মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধি হয় এবং অপরদিকে অনেক মানুষের জীবিকা সংস্থানের ব্যবস্থা করে।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর