ইটালির রেনেসাঁ বা নবজাগরণের পটভূমি বা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করো
অথবা, ইটালিতেই কেন প্রথম রেনেসাঁ বা নবজাগরণ ঘটেছিল

ভূমিকা
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ইউরোপে সাহিত্য, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবনবোধের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি ঘটেছিল, তা সাধারণভাবে ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণ নামে পরিচিত। ইটালিতেই প্রথম রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উদ্ভব হয়। পরবর্তীকালে সমগ্র ইউরোপে তা প্রসারিত হয়। ইটালিতেই কেন প্রথম রেনেসাঁর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে, তা নিয়ে ঐতিহাসিকগণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
(1) কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের প্রভাব: ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করেন। খ্রিস্টান সংস্কৃতির ধারক এই নগরী মুসলিমদের হস্তগত হওয়ায় এখানকার জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতরা কনস্ট্যান্টিনোপল ত্যাগ করতে থাকেন। এই পণ্ডিতগণ বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার মূল স্তম্ভ ছিলেন। তাঁরা তাঁদের প্রাচীন পুথিপত্র নিয়ে ইটালির বিভিন্ন নগরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইটালির ধনী বণিক ও বহু অভিজাতরা এইসকল পন্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পন্ডিতগণ ইটালির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। তারা বেশ কিছু নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এইভাবে ইটালিতে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ধ্রুপদি যুগের সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক চর্চা এবং প্রসার ঘটে। এইভাবে ইটালিতে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূচনা হয়।
(2) শাসক ও বণিক শ্রেণির ভূমিকা: ইটালিতে নবজাগরণের উদ্ভবে শাসক ও ধনী বণিক শ্রেণির যথেষ্ট অবদান আছে। মূলত তাঁদের উদ্যোগে প্রাচীন পান্ডুলিপির উদ্ধার ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়। পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে বিশেষত ইটালিতে প্রথম এই কাজ শুরু হয়। ইটালির ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ কাজ সম্ভব হত না। পোপ পঞ্চম নিকোলাস, পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস, পোপ দশম লিও প্রমুখের প্রচেষ্টা ও আর্থিক সাহায্যে রোমে বেশ কয়েকটি গ্রন্থাগার নির্মিত হয়েছিল। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত এইসকল প্রাচীন পুথি-পান্ডুলিপি ইটালিকে ইউরোপের জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করেছিল।
(3) ভৌগোলিক অবস্থান: ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ হওয়ার কারণে মধ্যযুগে ইটালি ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। ফলে ইটালিতে বাণিজ্যভিত্তিক নগররাষ্ট্র (ফ্লোরেন্স, মিলান, ভেনিস প্রভৃতি) গড়ে উঠেছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই নগররাষ্ট্রগুলির শাসন ছিল সামন্ততন্ত্রের অনেকটাই প্রভাবমুক্ত। ব্যাবসাবাণিজ্যের সূত্রে এই নগরগুলিতে যে ধনী বণিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে, তারাই শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
(4) সহমর্মিতা ও সহাবস্থানের পরিবেশ: ইটালি ছিল বিভিন্ন জাতির মিলনভূমি। এখানে ফ্রাঙ্ক, জার্মান, নর্ম্যান, গথ প্রভৃতি জাতি পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করত। ফলে এখানকার সামাজিক জীবনে সহমর্মিতা, সহনশীলতার চর্চা ছিল। তাই ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পণ্ডিতরা শান্তিতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করতে পারতেন। এই শান্তি ও সহমর্মিতার পরিবেশ রেনেসাঁকে ত্বরান্বিত করেছিল।
(5) নগররাষ্ট্রগুলির ভূমিকা: ইটালিতে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির বদলে বণিক পরিবারভিত্তিক নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। উদাহরণ হিসেবে ফ্লোরেন্সের মেদিচি রাজপরিবারের কথা বলা যায়। এই নগরগুলিতে স্বাধীন চিন্তাধারা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটেছিল। এই নগররাষ্ট্রে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত শাসনব্যবস্তা গড়ে উঠেছিল। সাহিত্য-শিল্পের উন্নতি নিয়েও নগররাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। তাই শিল্পীদের নতুন নতুন সৃষ্টির ব্যাপারে শাসকশ্রেণি পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায় যে, ইটালির অনুকূল আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্তিতির কারণেই প্রথম নবজাগরণ ঘটেছিল। ঐতিহাসিক জ্যাকব বুখার্ড (Jacob Burckhardt)-এর মতে, মধ্যযুগের শেষ থেকেই ইটালিতে ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যাচর্চা শুরু হয়েছিল, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশে অকল্পনীয় ছিল। ফলে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম বিকাশ ও প্রসার ইটালিতেই ঘটেছিল।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর