ইতালির ঐক্য আন্দোলন, ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা

ইতালির ঐক্য আন্দোলন, ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা
ইতালির ঐক্য আন্দোলন, ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা

ইতালির ঐক্য আন্দোলন

ইতালিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ

ইতালি ছিল সুপ্রাচীন রোমান সভ্যতার লীলাভূমি এবং পঞ্চদশ শতকের ইউরোপীয় নবজাগরণের পীঠস্থান। ফরাসি বিপ্লবের আগে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে ইতালি পরস্পর-বিবদমান অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই রাজ্যগুলির মধ্যে অধিকাংশ ছিল বিদেশি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন ইতালি জয় করে ক্রমে প্রায় সমগ্র ইতালিকে এক শাসনাধীনে আনেন। এর ফলে ইতালিবাসীর মনে ঐক্যবোধ ও জাতীয় চেতনার সঞ্চার হয় এবং তারা নিজেদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। নেপোলিয়নের পতনের পর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সম্মেলনে মিলিত নেতৃবৃন্দ ‘ন্যায্য-অধিকার নীতি ‘অনুসারে ইতালির নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে ইতালিকে ক্ষুদ্র-বৃহৎ কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত করেন। ইতালিতে পুনরায় বৈদেশিক শক্তি ও সামন্তপ্রভুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যুগে ইতালি বলতে কোনো স্বতন্ত্র বা ঐক্যবন্ধ রাষ্ট্রকে বোঝাত না। আটটি রাজ্যে বিভক্ত ইতালি তখন একটি ‘ভৌগোলিক সংজ্ঞা’-য় পরিণত হয়। ইতালির এই শোচনীয় অবস্থার ফলে দেশপ্রেমিকদের মনে প্রবল হতাশার সৃষ্টি হয়।

‘রিসর্জিমেন্টো’ আন্দোলন

জাতীয় জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে ইতালিবাসীর মনে এক ঐক্যবোধ ও জাতীয় চেতনার সঞ্চার হয়, যা রিজিমেন্টো বা পুনর্জাগরণ নামে খ্যাত। এইসময় ইতালিতে ক্রোয়া, কান্ডু, ক্যাপ্পোনি প্রমুখ ঐতিহাসিক, এবং লিওপার্ডি, আজেগলিও প্রমুখ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও চিন্তাবিদের আবির্ভাব হয়। তাঁদের রচনাবলি ইতালিবাসীর মনে গৌরববোধ ও জাতীয় চেতনার সঞ্চার করে। এই নতুন চেতনা বা আন্দোলনের নাম রিজিমেন্টো’ বা ‘পুনরুত্থান’। এর ফলে ইতালিবাসী তাদের অতীত গৌরব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং ইতালি থেকে বিদেশি প্রভুত্বের অবসান ঘটিয়ে ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়।

কার্বোনারি আন্দোলন

জাগরণের ফলে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে ইতালিতে বেশ কিছু গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। তাদের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র পথে বিপ্লবের মাধ্যমে ইতালির বন্ধনমোচন। এইসব গুপ্ত সমিতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল ‘কার্বোনারি’। সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা ও বিপ্লবের পথে বিদেশির কবল থেকে ইতালিকে মুক্ত করে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য। নতুন সংবিধানের দাবিতে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘কার্বোনারি’ ও অন্যান্য গুপ্ত সমিতির উদ্যোগে মধ্য ইতালির বিভিন্ন রাজ্যে প্রবল গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়। গণ সমর্থন, যোগ্য নেতৃত্ব, উপযুক্ত রাজনৈতিক আদর্শ ও গঠনমূলক পরিকল্পনার অভাবে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

জোসেফ ম্যাৎসিনি ও ‘ইয়ং ইতালি’ আন্দোলন

‘কার্বোনারি’ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জোসেফ ম্যাৎসিনি (১৮০৫-৭২ খ্রিঃ) ও তাঁর ‘ইয়ং ইতালি’ বা ‘নব্য ইতালি’ দল। ম্যাৎসিনি ছিলেন ইতালিয় ঐক্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, কেবল গুপ্তহত্যা বা সন্ত্রাসবাদের দ্বারা ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে না। এর জন্য দরকার জনজাগরণ-দরকার যুবশক্তির উন্মেষ। এই উদ্দেশ্যে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ইয়ং ইতালি’ বা ‘নব্য ইতালি’ নামে একটি যুব সংগঠন তৈরি করেন। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত যে-কোনো ব্যক্তি এর সভ্য হতে পারত। ম্যাৎসিনি যুব-সম্প্রদায়কে তাঁদের উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে সচেতন করে দিয়ে বলেন যে, ধর্ম ও দেশপ্রেম এক ও অভিন্ন, এবং যুবকদের কাজ হল গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও ইতালির অতীত গৌরব-কাহিনি ছড়িয়ে দেওয়া। এ উদ্যোগও ব্যর্থ হয়।

কাউন্ট ক্যাভুর (১৮১০-৬১ খ্রিঃ) ও ইতালির ঐক্য আন্দোলন

‘ইয়ং ইতালি ‘আন্দোলনের ব্যর্থতার পর বাস্তববাদী ও দক্ষ কূটনীতিক কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর (১৮১০-১৮৬১ খ্রিঃ) ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে ‘ইতালির ঐক্য আন্দোলনের মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করা হয়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর জন্মস্থান পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া-র মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন এবং ১৮৫২-তে রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বিদেশি সাহায্য ব্যতীত ইতালির ঐক্যসাধন অসম্ভব। তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ

ইতালীয় সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করার উদ্দেশ্যে ক্যাভুর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিভিন্ন পত্রিকায় ইতালির সমস্যাবলি সম্পর্কে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন। এছাড়া তিনি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাহায্যলাভের চেষ্টা করেন। এ সময় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-১৮৫৬ খিঃ) শুরু হলে তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে যোগদান করেন। যুদ্ধাবসানে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে (১৮৫৬ খ্রিঃ) উপস্থিত হয়ে তিনি সেখানে ইতালির সমস্যার কথা তুলে ধরে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হন। এইভাবে ইতালির সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়।

প্লমবিয়ার্স-এর চুক্তি

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্লমবিয়ার্স নামক স্থানে ক্যাভুর ও ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের মধ্যে এক গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (১৮৫৮ খ্রিঃ)। এই চুক্তি ‘প্রমবিয়ার্স-এর চুক্তি’ নামে খ্যাত। এই চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে পিডমন্টকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে তবে অস্ট্রিয়া যদি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে প্রথমে আক্রমণ করে, তবেই এ সাহায্য মিলবে। এই সাহায্যের বিনিময়ে ফ্রান্স স্যাভয় ও নিস্ লাভ করবে।

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ফ্রান্সও যুদ্ধে যোগ দেয়। ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনো-র যুদ্ধে জয়লাভ করে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ও ফরাসি বাহিনী অস্ট্রিয়ার কবল থেকে লম্বার্ডি ও মিলান উদ্ধার করে। সংযুক্ত উত্তর ইতালি রাজ্যের উদ্ভব শুরু হয়।

মধ্য ইতালির সংযুক্তি

ইতিমধ্যে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে মধ্য ইতালির পার্মা, মডেনা, টাস্কেনি, রোমানা প্রভৃতি রাজ্য পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করে। এতে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ও অস্ট্রিয়া আপত্তি জানায়। ক্যাভুর তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় আসেন। স্থির হয় যে, তৃতীয় নেপোলিয়ন মধ্য ইতালির ওই রাজ্যগুলির সংযুক্তিতে আপত্তি করবেন না এবং বিনিময়ে গ্যারিবন্ডি তিনি স্যাভয় ও নিস্ পাবেন। গণভোটের মাধ্যমে এই রাজ্যগুলি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ইতালির ঐক্য আন্দোলন আর এক ধাপ অগ্রসর হয়।

দক্ষিণ ইতালি জয়

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ইতালির নেপল্স ও সিসিলি-তে প্রতিক্রিয়াশীল ফরাসি বুরবো শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহীরা ম্যাৎসিনি-শিষ্য ‘সিংহহৃদয়’ জাতীয়তাবাদী বীর জোসেফ গ্যারিবল্ডি-র কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়। গ্যারিবল্ডি (১৮০৭-১৮৮২ খ্রিঃ) নেপল্স ও সিসিলির আবেদনে সাড়া দিয়ে এক সহস্র ‘লাল কোর্তা’ বাহিনী নিয়ে সিসিলি ও নেপল্স জয় করে (অক্টোবর, ১৮৬০ খ্রিঃ) নিজ অধিকারে আনেন।

পোপের রাজ্য জয়

এরপর ভিক্টর ইমান্যুয়েল রোম বাদে পোপের সমগ্র রাজ্য জয় করেন। নেপলস ও সিসিলি গণভোটের মাধ্যমে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টর ইমান্যুয়েল ইতালির রাজা’ ঘোষিত হন। ভেনেশিয়া ও রোম ব্যতীত সমগ্র ইতালি তখন ঐক্যবদ্ধ। ওই বছরই মাত্র একান্ন বছর বয়সে ক্যাভুর মৃত্যুমুখে পতিত হন।

ভেনেশিয়া ও রোম জয়

তখনও ভেনেশিয়া ও রোমে যথাক্রমে অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। ভিক্টর ইমান্যুয়েলও এই স্থান দুটি অধিকারের জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রো-প্রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে ইতালি প্রাশিয়ার পক্ষে যোগ দেয়। স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হলে ভেনেশিয়া ইতালির অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে ইতালি প্রাশিয়াকে সমর্থন করে। সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয় এবং রোম থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করে নিলে রোম ইতালির অধিকারে আসে। এইভাবে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে একটি ‘ভৌগোলিক সংজ্ঞা’ থেকে জন্ম নেয় স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ ইতালি।

Leave a Comment