এপিকিউরীয় ও সিনিক রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা করো

এপিকিউরীয় ও সিনিক রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা করো

সম্পূর্ণ নতুন রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে এপিকিউরীয়, সিনিক ও স্টোয়িক দর্শন রাষ্ট্রচিন্তার জগতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল মূলত গ্রিক নগররাষ্ট্রের কাঠামোকে সামনে রেখে তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তা ব্যক্ত করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক নাগাদ গ্রিক নগররাষ্ট্রের ভাঙন শুরু হয়। প্রথমে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হলে নগররাষ্ট্রগুলি ছোটো ছোটো উপনিবেশের চেহারা নেয়। এরপর গ্রিসের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক জীবনের এই ভাঙন সম্পূর্ণ হয় সমগ্র গ্রিস রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ অব্দ)। নগররাষ্ট্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত রাষ্ট্রদর্শনগুলিও প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় কয়েকজন গ্রিক পণ্ডিত নতুন রাষ্ট্রদর্শন উপস্থাপিত করেন। এ প্রসঙ্গে এপিকিউরীয় (The Epicureans), সিনিক (The Cynics) ও স্টোয়িক (The Stoics) দর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এপিকিউরীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য

এপিকিউরাস (Epicurus) প্রবর্তিত রাষ্ট্রতত্ত্ব এপিকিউরীয় দর্শন নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৬ অব্দে এপিকিউরাস তাঁর গোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। এই রাষ্ট্রদর্শনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল-

(i) এই প্রকার দর্শনে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ন্যায়নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

(ii) এঁদের মতে, প্রাকৃতিক আইন হল সকলের সুবিধার লক্ষ্যে তৈরি অলিখিত বিধান। একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে আক্রমণ করবে না এবং নিজেও অন্যের দ্বারা আক্রান্ত হবে না— এমন এক ধরনের চুক্তির দ্বারা এই প্রাকৃতিক আইন বাস্তবায়িত হবে।

(iii) এপিকিউরীয়ান দর্শনের চরিত্র অরাজনৈতিক। এপিকিউরীয় তাত্ত্বিকগণ মানুষকে যথাসম্ভব রাজনীতি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।

(iv) তাঁরা বলেন যে, ব্যক্তিমানুষের সুন্দর জীবনের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। এই বৃহৎ বিশ্বে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ, যন্ত্রণা এড়িয়ে সুখ আহরণের চেষ্টা করবে।

(v) প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচ্চনীচ, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন ইত্যাদি বৈষম্য আছে। এঁদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণা এক সাম্যবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা করবে বলে দাবি করা হয়।

(vi) এই গোষ্ঠীর তাত্ত্বিকদের মতে, রাষ্ট্র স্বৈরাচারী, গণতান্ত্রিক বা অভিজাততান্ত্রিক কীরূপ হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল কোন্ সরকার কতটা কার্যকরীভাবে শান্তি স্থাপন করতে সক্ষম তা বিবেচনা করা।

(vii) আইনবিধি ও শাসন সংগঠনগুলির গুরুত্ব এবং স্থায়িত্বের একমাত্র মাপকাঠি হল তাদের কার্যকারিতা বা উপযোগিতা। এপিকিউরীয়রা মনে করেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন সাপেক্ষে আইনবিধির পরিবর্তন ঘটানো আবশ্যিক।

(viii) এপিকিউরাস স্বয়ং গ্রিক দার্শনিক এমপিডক্লিস (Empedocles)-এর Natural Selection Theory বা প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। Principal Doctrines, The Extant Remains ইত্যাদি রচনায় এপিকিউরাস-এর নির্বিকারবাদী ও বস্তুবাদী চিন্তাভাবনার পরিচয় মেলে।

সিনিক রাষ্ট্রদর্শনের বৈশিষ্ট্য

সিনিক (The Cyncis) গোষ্ঠীর তাত্ত্বিকদের রাষ্ট্রদর্শনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যথা-

(i) সিনিকদের রাষ্ট্রদর্শন ছিল কল্পনাধর্মী (Utopian) এবং নৈরাষ্ট্রবাদী। নৈতিক চরিত্র গঠন ছাড়া সবকিছুতেই ছিল এঁদের নিস্পৃহতা।

(ii) সম্পত্তিবিহীন, পরিবারবিহীন, সরকারবিহীন এক অপূর্ব সমাজব্যবস্থা ছিল সিনিকদের কল্পনার জগৎ।

(iii) এঁরা সামাজিক সাম্যের কথা বলেছেন। স্যাবাইন-এর মতে, সিনিকদের সাম্যবাদ ছিল রাশিয়ার নিহিলিস্টদের সাম্যবাদের অনুরূপ। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁরা সিনিক নামে পরিচিতি পান। স্যাবাইন-এর মতানুসারে, সিনিকদের প্রথম সর্বহারার দার্শনিক বলে গণ্য করা যেতে পারে।

(iv) সদ্‌গুণসম্পন্ন বিজ্ঞ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিধিবদ্ধ জীবনযাপন করেন। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থা তাঁদের কাছে অপ্রয়োজনীয় – একথাই মনে করেন সিনিক দার্শনিকগণ।

(v) নগররাষ্ট্র (Citystates) নয়, বিশ্বনগরী (City of the World) ছিল সিনিকদের কাছে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা। সিনিকগণ প্রচলিত প্রথা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাঙন ঘটিয়ে যেভাবে এক প্রাকৃতিক বা আদিম শক্তির জীবন ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছিল, সেই কারণে এই দর্শনকে ধ্বংসাত্মক ও নেতিবাচক দর্শন ছাড়া কিছু বলা যায় না। এককথায় বলতে গেলে সিনিক রাষ্ট্রতত্ত্ব ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, নেতিবাচক ও নৈরাজ্যবাদী আদর্শের সমাহার। পরবর্তীকালে স্টোয়িক দর্শনে বিশ্বজনীনতার যে আদর্শের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়, সেখানে সিনিকবাদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন – কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল

Leave a Comment