ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ

ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ
ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ

সূচনা: অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, উপনিবেশবাদের মধ্যে দিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির আন্তঃ-রাষ্ট্র দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা প্রকাশ পেয়েছিল। এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিভিন্ন চাহিদা ও চিন্তাভাবনা। উপনিবেশ স্থাপনের মূলে শিল্পোন্নত দেশগুলির লক্ষ্য ছিল দ্বিবিধ উপনিবেশগুলি থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং নিজেদের কারখানায় তৈরি ভোগ্যপণ্য বিক্রয়ের জন্য বাজার দখল করা। অনেকে আবার গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি নিজ দখলে রাখার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে যোগ দেয়। প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়। এছাড়া জনবল বৃদ্ধি, অনেকে আবার জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে সাম্রাজ্য উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার জন্য স্থান-সংকুলান, ধর্মপ্রচার প্রভৃতি বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় নামে। অধ্যাপক জেমস জোল বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের জন্য নানা কারণকে দায়ী করা যায়- কোনোও একটি নির্দিষ্ট কারণ দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না।

উদ্বৃত্ত পণ্যের বিক্রির বাজার

শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের অর্থনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন আসে। কলকারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর পরিমাণ অভাবনীয় রূপে বৃদ্ধি পায়। এইসব পণ্যাদি বিক্রির জন্য বাজারের প্রয়োজন হয়। ইউরোপের দেশগুলিতে এইসব উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রির কোনও সুযোগ ছিল না, কারণ প্রায় সব দেশই ছিল শিল্পোন্নত এবং সকলেরই পণ্যসামগ্রী ছিল উদ্বৃত্ত। এছাড়া, এইসব দেশগুলি বিদেশি পণ্যাদির অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য ‘শিল্প-সংরক্ষণ নীতি’ গ্রহণ করে। এর ফলে প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশেই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় শিল্পে অনুন্নত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির দিকে সবার নজর পড়ে। কাঁচামালের জোগান, – ইউরোপীয় পণ্যের বাজার এবং সর্বোপরি সস্তায় শ্রমিক প্রাপ্তি প্রভৃতি দিক থেকে এই দেশগুলি ছিল খুবই লোভনীয়। বাজার দখল, কাঁচামাল সংগ্রহ এবং বাণিজ্যিক লগ্নীর কারণে এইসব দেশগুলিতে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

হবসনের ব্যাখ্যা

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. এ. হবসন ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর সাম্রাজ্যবাদ-একটি সমীক্ষা’ (Imperialism – A Study) গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাতে কোনও উচ্চতর লক্ষ্য বা আদর্শ ছিল না- অর্থনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এর মূলে। তিনি বলেন যে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের হাতে প্রচুর মূলধন সঞ্চিত হয়। পুঁজিপতিরা এই মূলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আরও মুনাফা অর্জনের জন্য নিজ নিজ দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে। উপনিবেশের নতুন শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করে তারা সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। উপনিবেশের কাঁচামাল এবং একচেটিয়া বাজার তাদের অবস্থা আরও উন্নত করে। সুতরাং ‘বাড়তি মূলধনের চাপ’-ই হল সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ।

লেনিনের ব্যাখ্যা

বিশিষ্ট বুশ কমিউনিস্ট নেতা লেনিন ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ: পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ পুস্তিকায় সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে আরও বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, পুঁজিবাদের জঠরেই সাম্রাজ্যবাদের জন্ম। পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হয়। অধিক মুনাফা লাভের আশায় শিল্প-মালিকরা দেশের প্রয়োজনের বেশি বাড়তি মাল উৎপাদন করে। এই বাড়তি মালের বিক্রি এবং সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের আশায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখলের চেষ্টা করে। উপনিবেশের সংখ্যা সীমিত। এর ফলে উপনিবেশ দখলের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল যুদ্ধ। লেনিনের মতবাদ ত্রুটাহীন নয়। তবু বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের ক্ষেত্রে শিল্পবিপ্লব, কাঁচামাল সংগ্রহ, বাজার দখল প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ।

ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ

ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে বা অন্যভাবে বলা যায় যে, উগ্র জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তীব্রতর করে তোলে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের সূচনায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক ধরনের উগ্র, স্বার্থপর ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব হয়। সব জাতিই নিজের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতে থাকে এবং অন্যান্য জাতি ও দেশকে পদানত করে নিজ নিজ দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়। এইভাবে ইউরোপের বিভিন্ন জাতির মধ্যে এক ধরনের বিদ্বেষ ও জাতিবৈরিতার সৃষ্টি হয়। জার্মান দার্শনিক হেগেল ঘোষণা করেন যে, রাষ্ট্রই ঈশ্বর এবং রাষ্ট্রের গৌরবে জাতির গৌরব। জার্মান সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম বিশ্বে টিউটনিক জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ইংরেজ লেখক হোমার লী অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেন। ক্লেমেসো ও পোঁয়াকারে প্রমুখ ফরাসি নেতা ফরাসি ল্যাটিন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেন। নিজ নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকলেই উপনিবেশ বিস্তারে অগ্রসর হয়। এর ফলে যে নতুন ধারণা সৃষ্টি হয়, তাকে বলা হয়েছে ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’ অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় সব থেকে শক্তিমানই টিকে থাকবে।

Leave a Comment