কনফুসিয়াস মতবাদ কী
অথবা, কনফুসীয় ভাবধারার মূল বিষয় বা ধারণা কী

কনফুসিয়াস মতবাদশ
(1) কনফুসীয় মতবাদের সাহিত্যিক উপাদান: কনফুসিয়াস ও তাঁর মতাদর্শ সম্পর্কে জানা যায় মূলত ‘লুন-উ’ বা বচনসংগ্রহ (Analects) গ্রন্থ থেকে। তাঁর কোনও শিষ্য এটি সংকলন করেছেন। কনফুসিয়াসের নিজের লেখা একমাত্র গ্রন্থটি হল লু রাজ্যের ইতিবৃত্ত (Annals of the State of Lu)। আবার কনফুসিয়াসের বাণীর সংকলন মেনসিয়াসের গ্রন্থ (Book of Mencius), তাঁর নীতিবিদ্যার সংকলন টা-সুয়ে বা মহাবিদ্যা (The Great Learning) ও চুং ইয়াং বা মধ্যপন্থা (Doctrine of the Mean) নামক গ্রন্থ থেকে নানা তথ্য পাওয়া যায়।
কনফুসিয়াসের ধর্মানুশাসন বিষয়ক অন্যান্য চারটি সংকলন হল- ই-কিং বা পরিবর্তন গ্রন্থ (Book of Changes), সু কিং বা ইতিহাস গ্রন্থ (Book of History), সি কিং বা কাব্যগ্রন্থ (Book of Odes) এবং লি চি বা অনুষ্ঠান বিষয়ক গ্রন্থ (Records of Rites)। এই নয়টি গ্রন্থকে একত্রে কনফুসীয় বাইবেল (The Confucian Bible) বলা হয়। এ ছাড়া ১৬৯১ (মতান্তরে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ) খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে The Morals of Confucius: A Chinese Philosopher নামক একটি গ্রন্থ থেকে কনফুসিয়াসের জীবনচরিত, তাঁর সৃষ্টি, দার্শনিক চিন্তার মূলসূত্র-সহ ৮০টি শিক্ষামূলক বাণী সংকলিত হয়েছে
কনফুসিয়াস মতবাদ বা কনফুসীয়পন্থা হল চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি দার্শনিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় ব্যবস্থা, যা পূর্ব এশীয় সমাজ-সংস্কৃতির উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। পৃথিবীর অন্যকোথাও এত দীর্ঘসময় ধরে কোনও মতাদর্শের রাষ্ট্রনীতি ও সমাজজীবনকে প্রভাবিত করার নজির নেই। তাঁর মতবাদ – রু-বাদ (Rusism) নামে পরিচিত। কনফুসীয়পন্থার মূল দিকগুলি হল-
(2) ‘চু-ই’ (চাই) ধর্ম: কনফুসিয়াসের মতাদর্শ তাঁর আমল থেকেই চু-ই বাচ্যুই বা ‘জু’ ধর্ম (Religion of Ju) নামে পরিচিত ছিল। এই ‘চু-ই’ অভিধায় যেসব পণ্ডিতবর্গ ভূষিত হতেন, তাঁরা অতীতচারিতার প্রতীকস্বরূপ চ্যু-টুপি এবং চ্যু-গাউন বা পোশাক পরিধান করতেন। একজন চু-ই-এর চরিত্র প্রসঙ্গে কনফুসিয়াস বলেছেন যে, উদার মনোভাব, নিয়মনীতি সম্পর্কে নমনীয়, ক্ষমতাসীন বা কায়েমি শক্তি সম্পর্কে নিস্পৃহ, সাফল্য বা অসাফল্যে স্থির, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ইত্যাদি গুণের অধিকারী হবেন তিনি।
(3) কনফুসিয়াসের নীতিধর্ম বা ‘লি’: কনফুসিয়াস আচার-অনুষ্ঠান এবং সংগীতের মাধ্যমে প্রাচীন পতনোন্মুখ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি নৈতিকতা ও রাষ্ট্রনীতির সাযুজ্য বজায় রাখার কথাও বলেছেন। কনফুসীয় নীতিধর্ম লি (Li) নামে পরিচিত।
(4) মানুষের গুণ: কনফুসিয়াস প্রাথমিকভাবে পাঁচটি নৈতিক গুণ অনুশীলনের উপর জোর দিয়েছেন। যথা- দানশীলতা, জ্ঞান অর্জন, পবিত্রতা, ন্যায্যতা এবং বিশ্বস্ততা। পাশাপাশি কনফুসিয়াসের শিক্ষার মধ্যে জেন (মানবিকতা), সু (পরার্থপরতা), লি (শালীনতা), ই (সত্যনিষ্ঠা), চি (প্রজ্ঞা), সিন (আন্তরিকতা) -এইসব মৌলিক গুণাবলির অনুশীলনের দ্বারা নৈতিক চরিত্রগঠনের কথাও বলা হয়েছে। কনফুসিয়াস পঞ্চ সম্বন্ধ অর্থাৎ, রাজার সঙ্গে প্রজা, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী, পিতার সঙ্গে পুত্র, ভ্রাতার সঙ্গে ভ্রাতা এবং বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, তার দিকনির্দেশ করেছেন।
(5) রেন: কনফুসিয়াস মতবাদে ন্যায়পরায়ণতা, মানবিকতা এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতির ধারণাকে ‘রেন’ বলা হয়। কনফুসিয়াস রেন-কে মানুষের স্বভাব বলেছেন। সান ইয়াৎ-সেন (Sun Yat-Sen)-এর মতে, রেন হল কনফুসিয়াস মতবাদের মূলনীতি।
(6) পরিবার প্রসঙ্গে চিন্তাধারা: কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন যে, নৈতিক ভিত্তিবিশিষ্ট সুশৃঙ্খল, আনন্দময় পরিবারের উপর সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে। পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যকে কনফুসীয়বাদে শিয়াও বলা হয়। তাঁর মতে, পুত্র তার পিতাকে নীতি সম্পর্কে বিনীতভাবে উপদেশ দিতে পারে, কিন্তু পিতা যদি এরপরেও নীতিবিরুদ্ধ কাজ করেন, তবে পুত্রের কর্তব্য হল অধিকতর শ্রদ্ধার সঙ্গে পিতার কাজের প্রতিবাদ জানানো।
(7) রাজনৈতিক মতাদর্শ: কনফুসিয়াস বলেছিলেন, একজন শাসক সর্বদা শাসকের মতো, প্রজা প্রজার মতো, পিতা পিতার মতো এবং পুত্র পুত্রের মতো আচরণ করবেন। তবেই উত্তম প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
(8) রাজশক্তি প্রসঙ্গে চিন্তাধারা: কনফুসিয়াস মনে করেন, প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে চিনের সম্রাট ঈশ্বরের পুত্রস্বরূপ এবং তিনি স্বর্গীয় পরোয়ানা (Mandate of Heaven)-এর ভিত্তিতে প্রজাপালন করেন। কোনও শাসক সুশাসন প্রদানে ব্যর্থ হলে স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কনফুসিয়াস কিন্তু বিপ্লবকে ঘৃণার চোখেই দেখেছেন। অবশ্য তিনি এটাও বলেছেন যে, রাষ্ট্র যেহেতু প্রজাকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে শাসকের উপর যদি প্রজা আস্থা হারায়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের পতন নিশ্চিত। বস্তুত চিনের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি কনফুসিয়াসের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। প্রচলিত অর্থে ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, তেমন কিছুই কনফুসিয়াস প্রচার করেননি। তাঁর বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, শান্তিশৃঙ্খলা ও চিনের সার্বিক প্রগতি। তাই কনফুসিয়াসকে ধর্মপ্রচারক না বলে নীতিধর্ম প্রচারক বলাই যুক্তিসংগত।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর