কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের প্রভাব/গুরুত্ব আলোচনা করো

কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের প্রভাব/গুরুত্ব আলোচনা করো

কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের প্রভাব/গুরুত্ব আলোচনা করো
কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের প্রভাব/গুরুত্ব আলোচনা করো

ভূমিকা

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ পূর্ব রোমান সম্রাট একাদশ কনস্ট্যানটাইনকে পরাজিত করে রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করেন। এইভাবে তুর্কিদের দ্বারা কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটে। কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ইউরোপের রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন, “১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আধুনিক ইউরোপের যাত্রা শুরু হয়েছিল।”

(1) বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি: কনস্ট্যান্টিনোপলকে কেন্দ্র করেই বাইজানটাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই সাম্রাজ্য দীর্ঘ হাজার বছরের বেশি সময়কাল টিকে ছিল। কিন্তু রাজধানী শহর কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের ফলে দীর্ঘস্থায়ী ও ঐতিহ্যবাহী বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।

(2) অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান: কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের ফলে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অবসান এবং অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অটোমান তুর্কিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে ইউরোপের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে অটোমান তুর্কিদের উত্থান ঘটে।

(3) ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন: তুর্কিরা কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে নেওয়ায় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিশেষত ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘকাল ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে খ্রিস্টান তথা রোমান সাম্রাজ্যের আধিপত্য বজায় ছিল। কিন্তু কনস্ট্যান্টিনোপল পতনের পর সেখানে তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার দীর্ঘকালীন বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিন্ন হয়। স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের বণিকরা প্রাচ্যে আসার নতুন পথের অনুসন্ধান করতে থাকে।

(4) নবজাগরণের প্রেরণা: তুর্কি আক্রমণে কনস্ট্যান্টিনোপল নগরীর পতনে একদল ইউরোপের পণ্ডিত আত্মরক্ষার্থে তাঁদের পুথিপত্র নিয়ে ইটালির বিভিন্ন নগরে আশ্রয়গ্রহণ করেন। এই পণ্ডিতগণ তাঁদের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির বহু বিলুপ্তপ্রায় পুথি, পান্ডুলিপি এনেছিলেন। এঁরা ধ্রুপদি গ্রিক ও লাতিন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা শুরু করেন। এগুলির চর্চার ফলে ইটালিতে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিল্প-মনন-মানবিকতা সবদিকে যে অভূতপূর্ব নতুন চেতনা জাগ্রত হয়, রচনা করে রেনেসাস বা নবজাগরণের প্রেক্ষাপট।

(5) ধর্মীয় প্রভাব: অটোমান তুর্কিরা রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনের বাস্তব তাগিদেই দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে একটা পরধর্মসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি করে। তুর্কি নববিজিত অঞ্চলগুলিতে তাদের মিলেট (Millet) ব্যবস্থায় অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার পেয়েছিল। ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটায় ধর্ম ও সমাজ ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন বা বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত হয়, যা ধর্মসংস্কারের পথকে প্রশস্ত করে।

(6) ভৌগোলিক আবিষ্কারের তাগিদ: কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যপথ তুর্কি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে ইউরোপীয় বণিকরা প্রাচ্যে আসার বিকল্পদের বাণিজ্যপথের সন্ধানে উদ্যোগী হয়, যা ভৌগোলিক আবিষ্কারের পটভূমি প্রস্তুত করে। সামুদ্রিক অভিযানের মাধ্যমে নতুন নতুন বাণিজ্য ও জলপথ এবং মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়। যা ইউরোপীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন নিয়ে আসে।

মূল্যায়ন

পরিশেষে বলা যায় যে, কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ইউরোপের মধ্যযুগীয় রাজনীতি-অর্থনীতির কাঠামোর পরিবর্তন ঘটায়। ইউরোপ আধুনিক যুগের দিকে ধাবিত হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে। ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপট রচনা করে।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment