![]() |
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল |
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ
প্রিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব: ক্রিমিয়ার যুদ্ধ বলকান সমস্যার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক অতি তুচ্ছ কারণকে উপলক্ষ করে এই যুদ্ধের সূত্রপাত। তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত খ্রিস্টের স্মৃতি-বিজড়িত পবিত্র জেরুজালেমের গ্রোটোর গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন বা রোমান ও গ্রিক ধর্মযাজকদের মধ্যে বিরোধ ছিল। ফ্রান্স ল্যাটিন ধর্মযাজকদের এবং রাশিয়া গ্রিক ধর্মযাজকদের সমর্থন করত। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের সঙ্গে এক সন্ধি দ্বারা ফ্রান্স জেবুজালেমের পবিত্র স্থান ও ল্যাটিন বা রোমান ধর্মযাজকদের ওপর অভিভাবকত্ব করার অধিকার পায়। আবার, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের কুচুক-কাইনার্ডজির সন্ধির দ্বারা রাশিয়া উক্ত স্থানগুলি ও গ্রিক ধর্মযাজকদের ওপর কর্তৃত্বাধিকার পায়। এইভাবে একটি ধর্মপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে একটি যুদ্ধ শুরু হয়।
প্রকৃত কারণ: রুশ সম্প্রসারণ
আসলে ধর্মীয় কারণ হল যুদ্ধের অজুহাত মাত্র। যুদ্ধের প্রকৃত কারণ হল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বুশ সম্প্রসারণ এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির স্বার্থপ্রণোদিত আচরণ। রাশিয়ার লক্ষ ছিল কৃষ্ণসাগরের ওপর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছানো। রাশিয়া মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া দখল করলে তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ এ ব্যাপারে আপত্তি জানায়। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে তারা সকলেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। আসলে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের স্বার্থই ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রকৃত কারণ। রাশিয়া কর্তৃক মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া অধিকৃত হলে শঙ্কিত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ভিয়েনাতে মিলিত হয় এবং রাশিয়ার কাছে মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। রাশিয়া এই দাবি অগ্রাহ্য করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় (মার্চ, ১৮৫৪ খ্রিঃ)। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে যোগ দেয়।
প্যারিসের সন্ধি, ১৮৬৬ খ্রিঃ
১৮৫৪ (মার্চ) থেকে ১৮৫৬ (মার্চ) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু-বছর এই যুদ্ধ চলে। প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়া পরাজিত হয় এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধি দ্বারা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। সন্ধির শর্তানুসারে রাশিয়া তুরস্ককে মোলদাভিয়া, ওয়ালাচিয়া ও বেসারাবিয়া ফিরিয়ে দেয়। বৃহৎ শক্তিবর্গ তুরস্ক সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল
এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- এই যুদ্ধের দ্বারা বলকান অঞ্চল ও কৃষ্ণসাগরে তথা তুরস্কে বুশ অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ইতিপূর্বে তুরস্কের সেসব অঞ্চল রাশিয়া অধিকার করেছিল, তুরস্ক তা-ও ফিরে পায়।
- ইউরোপে বুশ বিস্তার-নীতি প্রতিহত হওয়ায় রাশিয়া মধ্য এশিয়ার দিকে বিস্তার-নীতি অবলম্বন করে। এর ফলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
- এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে জারতন্ত্রের দুর্বলতা সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বীতশ্রদ্ধ জনসাধারণ জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। গণ-বিক্ষোভ প্রশমনের জন্য জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার রাশিয়ায় বেশ কিছু উদারনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করেন।
- এই যুদ্ধের ফলে বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। ১৮৬২-তে মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়াকে যুক্ত করে রুমানিয়ার প্রতিষ্ঠা হয়।