![]() |
| চিনা তরমুজের খন্ডীকরণ বলতে কী বোঝো |
ষোড়শ শতকে পোর্তুগিজ এবং সপ্তদশ শতকে ওলন্দাজ, ইংরেজ ও স্পেনীয়রা চিনে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। চিনারা এইসব বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিল না। তারা সমস্ত বিদেশিদের ‘বর্বর’ ও ‘ম্লেচ্ছ’ বলে মনে করত। ফলে নানারকম অপমানজনক বিধি-নিষেধ ও শর্তাদি মেনে একমাত্র ক্যান্টন বন্দরে তারা বাণিজ্য করতে পারত। অফিমের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে চিনা শাসকদের প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ বা প্রথম অহিফেন যুদ্ধ হয় (১৮৩৯-১৮৪২ খ্রিঃ)। এই যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে চিনের দুর্বল মাঞ্জু শাসকরা পরাজিত হয় এবং অপমানজনক নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রিঃ) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা হংকং লাভ করে এবং ক্যান্টন-সহ পাঁচটি বন্দর ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই বন্দরগুলিতে ইংরেজরা ‘অতি-রাষ্ট্রিক অধিকার’ লাভ করে। ইংরেজদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আমেরিকা, ফ্রান্স, সুইডেন ও নরওয়ে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ বা দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধ (১৮৫৬-১৮৬১ খ্রিঃ) শুরু হয়। এই যুদ্ধে ফ্রান্স ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেয়। পরাজিত চিন ব্রিটিশ ও ফরাসিদের সঙ্গে তিয়েনসিন-এর সন্ধি (১৮৫৮ খ্রিঃ) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধি দ্বারা চিনের আরও এগারোটি বন্দর বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত হয়। এছাড়া, চিনে খ্রিস্টধর্ম প্রচার, বিদেশি দূতাবাস স্থাপন এবং বিদেশি বণিকদের চিনা আইনের এক্তিয়ার থেকে মুক্তি প্রভৃতি অধিকার স্বীকৃত হয়। এর ফলে বিদেশিরা চিনে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং মাঞ্জু শাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
এই সময় জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সকল শক্তিই চিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক ভিন্যাক বলেন যে, তরমুজকে যেমন লোকে খন্ড খন্ড করে খায়, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি ঠিক সেইভাবে চিনা তরমুজকে খণ্ড খণ্ড করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করতে থাকে।
- রাশিয়া লিয়াও-টুং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার দখল করে।
- জার্মানি কিয়াওচাও বন্দর দখলের পর শাংটুং প্রদেশেও তার অধিকার কায়েম করে।
- ইংল্যান্ড ওয়াইহ্যাওয়ে দখল করে। এর ফলে ইয়াংসি উপত্যকায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ফ্রান্স ইন্দোচিনের আনাম থেকে চিনের ভিতর পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রিত রেলপথ নির্মাণের অধিকার পায়। এর ফলে ফ্রান্স ইউনান, কোয়াংশি প্রভৃতি অঞ্চলের খনিজ সম্পদ রেলযোগে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।
- জাপান ফুকিয়েন প্রদেশ দখল করে।
চিনের ওপর এই বিদেশি আগ্রাসনে চিনে কর্মরত আমেরিকান বণিক ও মিশনারিরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারা আমেরিকার বাণিজ্যিক স্বার্থহানির আশঙ্কা করে মার্কিন সরকারকে হস্তক্ষেপের আবেদন জানায়। এ ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন হে (১৮৯৯ খ্রিঃ) তাঁর বিখ্যাত ‘মুক্তদ্বার নীতি’ (Open Door Policy) ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় যে,
- চিন সকল দেশের কাছেই সমান।
- সকল বিদেশি রাষ্ট্রই চিনের সর্বত্র সমান বাণিজ্যিক অধিকার ভোগ করবে এবং সমান হারে পোত ও বাণিজ্য শুল্ক দেবে। এই ঘোষণাপত্রে চিনের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার মহান আদর্শের কথা বলা হলেও, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল চিনের ওপর কোনো একটি রাষ্ট্রের প্রভুত্বের সম্ভাবনা বিনষ্ট করে, চিনে ব্যবসাকারী সব দেশের প্রভাবাধীন অঞ্চলে বাণিজ্যের দরজা উন্মুক্ত রাখা।
