![]() |
ছাত্রজীবনের সুখ দুঃখ রচনা |
ভূমিকা
‘থাকব না’ক বদ্ধ খাঁচায়’ কিম্বা ‘বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’-এই কথাগুলি ছাত্রছাত্রীরাই শোনাতে পারে। কারণ, ছাত্রজীবন মানুষের জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়-তা যুগপৎ সুখের ও দুঃখের। জীবন সংগ্রামে যোগ্য সৈনিক হওয়াই ছাত্রজীবনের কর্তব্য ও লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য ও কর্তব্য সাধনে সাফল্য ও ব্যর্থতা অনিবার্য। ব্যর্থতা দুঃখ বহন করে আনে, সাফল্য আনে সুখ। আবার সাফল্য ও ব্যর্থতাকে পায়ের ভৃত্য করে তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যায় বলেই তাদের কোনো প্রতিকূল শক্তি পরাজিত করতে পারে না। এমনকি ছাত্রছাত্রীদের যে নিজস্ব চিন্তাচেতনা আছে তা তাদের ঊর্ধ্বতনরা উপলব্ধি করতে পারেন না বলেই, তাদের মধ্যে আসে ব্যর্থতাজনিত দুঃখ। তবুও ছাত্রজীবন বেশিরভাগই দুঃখের না হয়ে সুখের হয়।
ছাত্রজীবনের কর্তব্য
ছাত্রজীবনের প্রধান কর্তব্য জ্ঞানার্জন। অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিত অধ্যয়নই জ্ঞানার্জনের প্রশস্ত পথ। প্রাচীন ভারতে ছাত্রজীবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘ছাত্রানাম্ অধ্যয়নং তপঃ’। ছাত্রজীবন তপস্যা ও সাধনার জীবন, তপস্যার ক্ষেত্র। এই তপস্যার জন্য চাই সংযম, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা। এছাড়া দেশ ও দশের কল্যাণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করাও ছাত্রজীবনের কর্তব্য। শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য যেহেতু মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষ সাধন তাই সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে তাদের বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়, তাই সুখ-দুঃখ ছাত্রজীবনের নিত্যসঙ্গী।
ছাত্রদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য
ছাত্রজীবনে সুখ
সব মানুষই সুখের প্রত্যাশী, ছাত্রছাত্রীরাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাহলে সুখ কী? সুখের স্বরূপ-ই বা কেমন? সুখের প্রকৃতি কি ব্যক্তিভেদে পৃথক?-এসব নানান প্রশ্ন ছাত্রজীবনেও ভীড় করে আসে। সংস্কৃত শ্লোকে সুখের প্রাপ্তির উপায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে-“বিদ্যা দদাতি বিনয়ং, বিনয়াদ যাতি পাত্ৰতাম্, পাত্ৰতাৎ ধনমাপ্নোতি, ধনাৎ ধর্ম ততঃ সুখম্।” অর্থাৎ বিদ্যা বিনয় দান করে, বিনয়ী ব্যক্তি যথার্থ মানুষ বা পাত্র, সেই মানুষ ধন অর্জন করে, ধন অর্জনে ধর্ম হয় এবং তাহলেই সুখ আসে। সুতরাং সুখী হতে হলে এই পরম্পরার প্রয়োজন আছে। আবার এও বলা যেতে পারে, সুখ পেতে গেলে অপরকে সুখ দিতে হয়। অপরকে সুখ দিতে না পারলে, সুখী করতে না পারলে সুখ পাওয়া যায় না বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সুখে অধিকার থাকে না। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তি, ‘পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল নাই।’ সুতরাং ছাত্রজীবনে সুখ আসতে পারে দুভাবে-নিজের ও অভিভাবকদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরীক্ষায় ভালো ফল করে চাকরি-বাকরির জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠলে। অথবা, নিজের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অন্যের প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে কিছুটা ত্যাগ করলে। দ্বিতীয় পথে যে সুখ তা চিরস্থায়ী এবং কল্যাণকর। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলে যে সুখ পাওয়া যায়, তা পরবর্তী জীবনকেও মধুর করে তোলে-যা ক্যারিয়ার-সর্বস্ব হওয়ার সুখ থেকে পৃথক। ক্যারিয়ার-সর্বস্ব হওয়ার সাফল্যজনিত যে সুখ তা নিজস্ব গণ্ডীর মধ্যে বন্ধ, পরের জন্য ত্যাগের মধ্য দিয়ে পরের সাফল্যের বা প্রাপ্তিজনিত যে সুখ তা মুক্তির আনন্দে দীর্ঘস্থায়ী। সুতরাং ছাত্রজীবনে বাবা-মা, পরিবার-পরিজনদের অধীনে থেকে তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী চলার মধ্যেও সুখ আছে। আবার এই গণ্ডী ভেঙে, নিজের সাফল্যকে ধরে রেখে অপরের সাফল্যের পেছনে সামান্য অবদান রেখে সুখ লাভ করা সম্ভব। বলাবাহুল্য ছাত্রজীবনে সেই সুখ-ই কাম্য, যে সুখ অপরের সুখের আনন্দজনিত।
ছাত্রজীবনের দুঃখ
এরপর আসি দুঃখের কথায়। দুঃখ কী? দুঃখ হল প্রত্যাশার অপূরণজনিত এক ধরনের মানসিক অবস্থা। ছাত্ররা চায় নিজের মতো করে চলতে। তাদের পিছুটান নেই, আছে সাহস, উদ্যম ও নিষ্ঠা। তাই তারা নিজেদের মতো করে চলতে গিয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। সেই প্রতিকূলতা পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ-যে কোনো মাধ্যম থেকেই আসতে পারে। প্রতিকূলতা এলে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, দ্বন্দু জয় করতে না পারলে সৃষ্টি হয় দুঃখের। আর সেই দুঃখের বেদনা ছাত্রজীবনকে করে তোলে ভারাক্রান্ত, কখনো বিপথগামী। তাই ছাত্রজীবনের দুঃখের উৎস যে মাধ্যম বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সেই মাধ্যম বা পরিবেশের যথাযথ উন্নতি সাধন জরুরি।
উপসংহার
মনে রাখতে হবে, আজকের ছাত্র ভবিষ্যতে দেশের সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে। তাই জাতীয় স্বার্থে ছাত্রছাত্রীদের উদ্যম, নিষ্ঠা, শ্রম-কে পাথেয় করে তাদের সুখ বা আনন্দকে ধরে রাখতে হবে। তারা যদি প্রতিকূলতা জয় করতে না পেরে দুঃখে পতিত হয়, তাহলে সেই দুঃখজনিত ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হয়ে যেতে পারে-যা জাতীয় স্বার্থে কাম্য নয়। তবে ছাত্ররা আত্মসুখ বা বস্তুগত সুখের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পরার্থসুখ বা আত্মিক সুখের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তেমনি জীবনে দুঃখ পেলে সেই দুঃখকে পাথেয় করে দুঃখ জয়ের সাধনাও ছাত্রছাত্রীদের করতে হবে-তাহলে তাদের সার্বিক বিকাশ ও কল্যাণ।