ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রচনা

ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রচনা
ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রচনা

ভূমিকা

প্রভাতে পূর্ব দিগন্তে সূর্যোদয় ও সায়াহ্নে পশ্চিম দিকে সূর্যাস্ত-সবই এক দুর্লঙ্ঘ্য নিয়মের অধীন। ছাত্রজীবন তথা মানবজীবনেও প্রয়োজন সেই কঠোর নিয়মের শাসন। ছাত্রজীবনকে সুন্দর করে তুলতে হলে তার জীবনেও আহ্বান করতে হবে শৃঙ্খলাবোধকে। কারণ শৃঙ্খলাই শ্রী অর্থাৎ সৌন্দর্য। নিয়মানুবর্তিতা সেই শৃঙ্খলাকে বজায় রাখার প্রধান হাতিয়ার। এছাড়া শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা ছাত্রদের অন্তর্নিহিত সত্তারও বিকাশ ঘটে।

শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা কী

‘শৃঙ্খলা’ শব্দটির মধ্যে ‘শৃঙ্খল’ কথাটির প্রকাশ নিহিত আছে। শৃঙ্খল বলতে এক ধরনের বন্ধন বোঝায়, কিন্তু শৃঙ্খলা শুধুমাত্র বন্ধন নয়, তা নিয়ন্ত্রণ ও সামঞ্জস্যবোধের যুগ্ম-তাৎপর্যে গঠিত। আর ‘নিয়মানুবর্তিতা’ হল নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলার স্বভাব। গাছ থেকে ফল পড়ে, পাখি আকাশে ওড়ে, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ইত্যাদি সব কিছুই নিয়মের বেড়াজালে আবন্ধ। তাই নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ ছাত্রজীবনের উপযুক্ত আশ্রয়স্থল। যার দ্বারা একজন সাধারণ মানের ছাত্রও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।

শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা

আমরা জানি, কারণ ছাড়া কাজ হয় না। এবং এই কারণ অনুসন্ধানে জাতীয় জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। সারা দেশ জুড়ে জাতি এবং সমাজের মধ্যে বৈষম্য ও ভেদাভেদের শেষ নেই। ধর্ম-জাতি-ভাষা-বর্ণ-সংস্কৃতিগত বৈষম্য হল আমাদের জাতীয় জীবনের অভিশাপ। ধনী-দরিদ্র, শোষক- শোষিত প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রেণিসংঘাত সমাজে অশান্তির দুষ্ট ক্ষতের মতো ছড়িয়েছে। বেকার সমস্যা যুব সম্প্রদায়কে অন্ধকারের দিকে নিমজ্জিত করেছে। তাদের হতাশা, অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ দেশ তথা সমাজের প্রতি আনুগত্যহীন করেছে। বাস্তবিকতাহীন শুষ্ক গ্রন্থনির্ভর শিক্ষা ছাত্রসমাজকে জীবনের নতুন পথ দেখাতে ব্যর্থ। এছাড়া দারিদ্র্য, কুশিক্ষা প্রভৃতি সমস্যায়ও জাতীয় জীবন জর্জরিত। তাই আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মনিষ্ঠার অভাব। এ থেকে মুক্তি পেতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে অভ্যাস ও অনুশীলনের প্রয়োজন।

ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা

সমগ্র ব্যক্তিজীবনের ভিত্তিস্বরূপ হল ছাত্রজীবন। আর ব্যক্তিজীবনের সমষ্টির দ্বারা গড়ে ওঠে জাতীয় জীবন। তাই ছাত্রজীবনকে জাতীয় জীবনের ক্ষুদ্রতম অঙ্গ বলা যেতে পারে। সুতরাং একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতি-অবনতির ক্ষেত্রে সেই দেশের ছাত্রজীবনের উন্নতি-অবনতি অনেকটাই দায়ী। শৃঙ্খলাবোধ যেহেতু জাতীয় সমৃদ্ধি ও উন্নতির সহায়ক, তাই ছাত্রজীবনেই শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা অনুশীলনের উপযুক্ত সময়। কারণ ছাত্রজীবন বিদ্যা ও নানা রকমের শিক্ষা গ্রহণের কাল। দেহ ও মনের সামগ্রিক পুষ্টিলাভেই ছাত্রজীবন চরিতার্থ। তাদের সমস্ত কর্মপন্থা একটি সুদৃঢ় নিয়মের বশবর্তী হবে এবং প্রতিটি কর্মধারার মধ্যে একটি পারম্পর্যবোধ দেখা দেবে। এই শৃঙ্খলাবোধ ছাত্রজীবনে সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার যোগফলে জন্মলাভ করে। যথাসময়ে নিজের কাজগুলি যথাযথভাবে সম্পন্ন করাই সময়ানুবর্তিতা। এই সময়ানুবর্তিতার মধ্যে ছন্দপতন ঘটলে বিপর্যয় আসে। আর জীবনের প্রতিটি ক্রিয়াকে নিয়মের একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলাই নিয়মানুবর্তিতা। সময়মতো নিয়ম করে কর্তব্য সম্পাদন করলেই জীবনে শৃঙ্খলাবোধ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কোনোমতেই আর বিপর্যয় বিশৃঙ্খলা জীবনের গতিপথকে ব্যাহত করতে পারে না। তাই ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা গুরুত্ব সহকারে গৃহীত ও বিবেচিত হয়ে থাকে।

উপসংহার

শৃঙ্খলা নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও নিয়ম যেন কখনো শৃঙ্খল হয়ে জীবনের স্বাভাবিক গতিছন্দকে ব্যাহত না করে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ নাটিকায় নিয়মের এই শৃঙ্খল জীবনের সার্বিক বিকাশকে রুদ্ধ করে মানুষকে যান্ত্রিক করে তুলেছে। শৃঙ্খলাবোধে কখনো জীবনকে যান্ত্রিক করে তোলার প্ররোচনা থাকে না। ছাত্রজীবনই জীবন গঠনের সময়, জীবনের প্রস্তুতির কাল-তা হল নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের কাল। এখানে জীবন যে পথে পরিচালিত হবে, সেই পথই হবে স্থায়ী জীবন পথ। সেই পথেই জীবন স্রোত প্রবাহিত হয়ে চলবে। শৃঙ্খলাবোধ হল জীবনের ভিত্তিশালা। তটবন্ধন ছাড়া যেমন নদীর গতি-স্পন্দন নেই- তেমনি ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন অসীম।

Leave a Comment