ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের পতনের পর ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ‘ন্যায্য অধিকার নীতি’-র ভিত্তিতে ফ্রান্সে প্রাচীন বুরবো রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের ভ্রাতা অষ্টাদশ লুই (১৮১৪-২৪ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন। এই সময় ফ্রান্সের রাজনীতি খুবই জটিল হয়ে ওঠে এবং ফ্রান্সে পরস্পর-বিরোধী মতাদর্শযুক্ত একাধিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। ফ্রান্সের সিংহাসনে বুরবোঁ রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশত্যাগী অভিজাত ও যাজকরা ফ্রান্সে ফিরে আসে। তারা বিপ্লবী আমলের সকল সংস্কার বাতিল করে তাদের পূর্বতন অধিকার ও পুরাতনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। এই উদ্দেশ্যে তারা উগ্র রাজতন্ত্রী দল গড়ে তোলে। এই দলের বিরুদ্ধে ছিল উদারতন্ত্রী গোষ্ঠী ও প্রজাতন্ত্রী গোষ্ঠী। তারা বিপ্লবী যুগের পরিবর্তনগুলিকে রক্ষা করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। এই দলগুলির পারস্পরিক সংঘাতে ফ্রান্সের অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে।
অষ্টাদশ লুই
ফরাসি সম্রাট অষ্টাদশ লুই স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে কখনই পূর্বতন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে তিনি ‘মধ্যপন্থা’ অবলম্বন করে পুনঃস্থাপিত রাজতন্ত্রের সঙ্গে বিপ্লবী ভাবধারার সমন্বয় করে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। তাঁর আমলে দেশে মোটামুটি শান্তি বজায় ছিল এবং জনগণের কাছেও তিনি সহনীয় ছিলেন।
দশম চার্লস
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে অষ্টাদশ লুই-এর মৃত্যু হলে তাঁর ভ্রাতা দশম চার্লস সিংহাসনে বসেন। তিনি ঈশ্বর-প্রদত্ত রাজতন্ত্র ও পুরাতনতন্ত্রের উগ্র সমর্থক ছিলেন। তাঁর লক্ষই ছিল অষ্টাদশ লুই অনুসৃত ‘মধ্যপন্থাকে’ বিসর্জন দিয়ে স্বৈরশাসন, অভিজাততন্ত্র ও ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্য স্থাপন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে দশম চার্লস পলিগন্যাক্ নামে জনৈক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তিনি ২৬শে জুলাই চারটি স্বৈরাচারী অর্ডিন্যান্স জারি করেন এবং এর দ্বারা আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিলোপ করা হয়, ভোটাধিকার সঙ্কুচিত করা হয় এবং অল্পসংখ্যক নাগরিকের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের দিন ঘোষিত হয়।
জুলাই বিপ্লবের সূচনা
এই অর্ডিন্যান্স জারির সঙ্গে সঙ্গে উদারপন্থী নেতা এডলফ থিয়ার্স (Thiers)-এর নেতৃত্বে প্যারিসের জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ মানুষ, ছাত্র ও শ্রমিকরা প্যারিসের রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৩০শে জুলাই বিদ্রোহী জনসাধারণ দশম চার্লসকে সিংহাসনচ্যুত করে অর্লিয়েন্স বংশের লুই ফিলিপ-কে ফ্রান্সের রাজা বলে ঘোষণা করে।
জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব ও প্রভাব
- ঐতিহাসিক গর্ডন ক্রেগ বলেন যে, দশম চার্লসের আমলে যে স্বৈরাচার স্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল জুলাই বিপ্লব তা ধ্বংস করে।
- এই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজবংশের পতন ঘটে এবং অর্লিয়েন্স রাজবংশের অধীনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাজা ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্ত নন- তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মাত্র এবং জনগণই হল প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এই বিপ্লবের ফলেই সাম্য, ধর্মনিরপেক্ষ শাসন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক নীতি ফ্রান্সে স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
- এই বিপ্লবের ফলে যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রাধান্য স্থাপন বা পুরাতনতন্ত্রের পুনঃস্থাপনের সব উদ্যোগ চিরতরে ব্যর্থ হয় এবং ধনী বুর্জোয়া সম্প্রদায়ই রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করে।
ফ্রান্সের বাইরে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব
জুলাই বিপ্লবের ঢেউ ফ্রান্সের সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপের নানা দেশে আছড়ে পড়ে। ঐতিহাসিক ফিশার বলেন, “প্যারিসের চুল্লি থেকে উড়ন্ত অগ্নিকণা শক্তি-সমবায় শাসিত ইউরোপের কাষ্ঠখন্ডের ওপর পড়ে এক দাবানলের সৃষ্টি করে।” ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সন্ধির দ্বারা বেলজিয়ামবাসীর দাবি উপেক্ষা করে বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সুযোগে বেলজিয়ামবাসী হল্যান্ডের সঙ্গে তাদের সংযুক্তি নাকচ করে স্বাধীন হয়ে যায়। জার্মানিতে ব্যাপক গণ-জাগরণ দেখা দেয়। জার্মানির স্যাক্সনি, হ্যানোভার, হেস, ব্যাডেন, ব্যাভেরিয়া প্রভৃতি স্থানের জনগণ জোর করে শাসকদের কাছ থেকে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র আদায় করে। শেষপর্যন্ত মেটারনিখের চাপে এই সব স্থানে আবার স্বৈরতন্ত্রই ফিরে আসে। ইতালির পার্মা, মডেনা ও পোপের রাজ্যে শাসন-সংস্কারের দাবিতে গণ আন্দোলন মেটারনিখের চাপে স্তব্ধ হয়ে যায়। বুশ-অধিকৃত পোল্যান্ডে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে জার প্রথম আলেকজান্ডার নিষ্ঠুর দমননীতির মাধ্যমে তা স্তব্ধ করে দেন। জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে ইংল্যান্ডে ‘চার্টিস্ট আন্দোলন’ শুরু হয়। স্পেন, পর্তুগাল ও সুইজারল্যান্ডে উদারনৈতিক শাসন-সংস্কার প্রবর্তিত হয়।
উপসংহার
বস্তুত, জুলাই বিপ্লব ইউরোপের সর্বত্র বিপ্লবী ভাবধারাকে জাগ্রত করলেও কোথাও জাতীয় আশা-আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে পারেনি। একমাত্র বেলজিয়াম ভিন্ন ইউরোপের জনগণের আশা-আকাঙ্খা কোথাও পরিতৃপ্ত হয়নি। এ সত্ত্বেও বলতে হয় যে, জুলাই বিপ্লবের ফলে ইউরোপের ওপর প্রসারিত মেটারনিখের বজ্রমুষ্টিতে আঘাত লাগে এবং এই বিপ্লব হল ১৮৪৮-এর বৃহত্তর বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্ব।