টমাস ক্রমওয়েলের বিভিন্ন সংস্কারগুলি মূল্যায়ন করো
অথবা, টমাস ক্রময়েলের প্রশাসনিক ও ধর্মীয় সংস্কারগুলি বিশ্লেষণ করো

ভূমিকা
টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সপ্তম হেনরির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অষ্টম হেনরি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। রাজা অষ্টম হেনরির মন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন টমাস ক্রমওয়েল। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং দক্ষ প্রশাসক। তিনি নানা শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে টিউডর প্রশাসনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
ক্রমওয়েলের প্রশাসনিক সংস্কার
অষ্টম হেনরির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে টমাস ক্রমওয়েল নানা প্রশাসনিক সংস্কারসাধন করেছিলেন। যথা-
(1) সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠন: টমাস ক্রমওয়েল ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দক্ষ প্রশাসক। তাই রাজার সচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভের পরেই তিনি একটি সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠনে সচেষ্ট হন। ইংরেজ ঐতিহাসিক জিওফ্রে এলটন বলেছেন, “টিউডর আমলে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো প্রবর্তনের কৃতিত্ব টমাস ক্রমওয়েলের প্রাপ্য।”
(2) কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পুনর্গঠন: সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠনের পাশাপাশি ক্রমওয়েল কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেও পুনর্গঠন করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি উনিশ জন কাউন্সিলরকে নিয়ে একটি প্রিভি কাউন্সিল গঠন করেন। এই প্রিভি কাউন্সিল নানা সরকারি কাজকর্ম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। এ ছাড়াও তিনি সেক্রেটারি বা রাজার ব্যক্তিগত সচিব পদ সৃষ্টি করে সেই পদে নিজে বসেন।
(3) অর্থনৈতিক সংস্কার: টমাস ক্রমওয়েল আর্থিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্দেশ্যে ছয়টি পৃথক বিভাগ গঠন করেন। তিনি এই বিভাগগুলির মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতেন। এই বিভাগগুলির মাধ্যমে তিনি প্রথাগত রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি চার্চ, সামন্তপ্রভুদের থেকে প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করে রাজকোশকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
(4) পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা: টমাস ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক আইন প্রণয়ন ও কর অনুমোদনের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করেন। তিনি সুকৌশলে অষ্টম হেনরিকে দিয়ে ঘোষণা করান যে, পার্লামেন্টে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা নিহিত আছে। তিনি পার্লামেন্টের সদস্যদের নানা অধিকার প্রদান করেন।
(5) রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি: টমাস ক্রমওয়েল এইভাবে নানা প্রশাসনিক সংস্কার ও পার্লামেন্টে বিভিন্ন আইন পাসের মধ্য দিয়ে রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তিনি অষ্টম হেনরিকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ধর্মীয় সংস্কারের বিভিন্ন দিক
টমাস ক্রমওয়েলের ধর্মসংস্কারের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পোপের আধিপত্যকে ধ্বংস করা এবং রাষ্ট্রে অষ্টম হেনরির সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি রিফর্মেশন পার্লামেন্ট গঠন করেন। এই পার্লামেন্টে নানা আইন পাসের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের পাশাপাশি অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদকে সুনিশ্চিত করা হয়।
(1) ‘অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি আইন’: টমাস ক্রমওয়েল রাজার ‘ভিকার জেনারেল’ বা মুখ্য ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন (১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ)। এরপর তিনি অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি (Act of Supremacy) নামে একটি আইন পাস করে ইংল্যান্ডের সকল চার্চকে রাজার নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার চেষ্টা করেন। এই আইনে রাজাকে ইংল্যান্ডের চার্চের সুপ্রিম হেড বা সর্বময় প্রভু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
(2) পোপের আধিপত্যের অবলুপ্তি: পার্লামেন্টে নানা আইন পাস করে ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের চার্চের ওপর পোপের কর্তৃত্বের অবলুপ্তি ঘটিয়ে রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
(3) জাতীয় চার্চ প্রতিষ্ঠা: চার্চের ওপর রাজার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডে জাতীয় চার্চ গঠন করেন। এইভাবে তাঁর নেতৃত্বে রোমান চার্চের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে।
(4) মঠের বিলুপ্তি: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রমওয়েল পার্লামেন্টে আইন পাস করে ইংল্যান্ডের ছোটো ছোটো মঠগুলি উচ্ছেদ বা ধ্বংস করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মঠগুলির সম্পত্তি আত্মসাৎ করা। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইংল্যান্ডে পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস নামে এক ধর্মীয় বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহীরা ক্রমওয়েলের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে তিনি তাঁদের কঠোর হাতে দমন করেন। এরপর বড়ো মঠগুলির ওপর সম্রাটের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায় যে, টমাস ক্রমওয়েল একের পর এক প্রশাসনিক সংস্কারের দ্বারা রাজতন্ত্র ও পার্লামেন্টের শক্তি ও মর্যাদাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেন। তিনি পার্লামেন্টের অভূতপূর্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি করে পার্লামেন্টীয় বা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তিপ্রতিষ্ঠা করেন। তা ছাড়া চার্চের ওপর রাজার কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের পথকে প্রশস্ত করেন। ঐতিহাসিক ডেভিস বলেছেন, “অষ্টম হেনরির ধর্মসংস্কার রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল।” কিন্তু অষ্টম হেনরির দ্বিতীয় বিবাহ ভেঙে যাওয়ায় এবং তাঁর কিছু প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে রাজা ক্রমওয়েলের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। শেষপর্যন্ত অষ্টম হেনরি রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন (১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ)। তথাপি, ইংল্যান্ডে আধুনিক শাসনতান্ত্রিক কাঠামো গঠন ও বিকাশে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর