তাও দর্শনের মূলতত্ত্ব বা বিষয়বস্তু লেখো

তাও দর্শনের মূলতত্ত্ব বা বিষয়বস্তু লেখো

তাও দর্শনের মূলতত্ত্ব বা বিষয়বস্তু লেখো
তাও দর্শনের মূলতত্ত্ব বা বিষয়বস্তু লেখো

প্রকৃতির আবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে চলতে পারলেই মানুষ শান্তি পাবে এবং জীবনে পূর্ণতালাভ করতে পারবে- মূলত এই নীতির উপর ভিত্তি করে তাওবাদী দর্শনের মূলসুর হল, প্রকৃতির পথের সন্ধান করা।

তাও দর্শনের মূলতত্ত্ব

(1) তাওবাদী দর্শন সম্পর্কিত ঐতিহাসিক উপাদান: চিনে উদ্ভূত তাওবাদী দর্শন সম্পর্কিত যে সামান্য কয়েকটি ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত গ্রন্থ হল, তাও-তে-কিং বা তাও-তে-চিং (Tao Te Ching)। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন প্রখ্যাত চিনা দার্শনিক লাওৎসি। তাও-তে-চিং কথাটিকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় Way of Virtue. পাঁচ হাজার শব্দ সংবলিত এই গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত- তাও-গ্রন্থ (Book of Tao) এবং তি-গ্রন্থ (Book of Ti)। তাও-তে-চিং ছাড়াও অপর প্রাচীন যে প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থে তাওবাদ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে, তার নাম ঝুয়াংজি (Zhuangzi)। খ্রিস্টপূর্ব কালের (আনুমানিক ৩৬৯-২৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) চিনা দার্শনিক ঝুয়াং ঝৌ বা চুয়াংৎসি (Zhuang Zhou বা Chuang Tzu) সম্ভবত এটি রচনা করেছিলেন।

(2) প্রকৃতির ভূমিকা: তাও আদর্শে মনে করা হয়, জ্ঞানের প্রকৃত উৎস প্রকৃতি। তাওবাদ যে স্বভাবধর্মের সন্ধান দেয়, সেই স্বভাবধর্মই নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতিকে। পাহাড়, নদী, মেঘ, নক্ষত্র- এসবই স্বভাবধর্মের বশবর্তী। তাই প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারলেই মানুষ মুক্তির পথ (The way) খুঁজে পাবে।

(3) তাওবাদে জীবনতত্ত্ব: তাওবাদী ধারণায় জগতের সবকিছুই আপেক্ষিক। যেহেতু বিশ্বজগৎ প্রকৃতির প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল, সেখানে মানুষের কর্মকাণ্ড গুরুত্বহীন। প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলতে পারলে প্রজ্ঞা লাভ হয়। এই পথেই মানুষ ধৈর্য, বিনয়, প্রেম, অহিংসা, চিন্তাশীলতা প্রভৃতি সদগুণের অধিকারী হতে পারে। মানুষকে মঙ্গল-অমঙ্গলের ঊর্ধ্বে উঠে ‘স্বভাবধর্ম’ দ্বারা সঠিক পথের সন্ধান করতে হবে। লাওসে তথা লাওৎসি-র শিক্ষানুসারে স্বভাবধর্মের অধিকারী প্রাজ্ঞ মানুষ কর্মের মধ্যে অকর্ম এবং অকর্মের মধ্যে কর্ম দর্শন করবেন। উপনিষদের ‘ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ’-এর তত্ত্ব তাও দর্শনে প্রতিফলিত হয়। তাও দর্শন শান্তিবাদী। তাওবাদীরা সংঘাতে ভরা সমাজে নিষ্ক্রিয় বা শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। তাঁদের মতে, সমাজ, সংসার, জীবন প্রাকৃতিক নিয়মেই আবর্তিত হবে, ব্যক্তির উদ্যোগ সেখানে নিষ্প্রয়োজন।

(4) তাওবাদে ধ্যানযোগ: পরমার্থ তত্ত্ব, শাসনতন্ত্র, রাষ্ট্রদর্শন এবং কর্মক্ষেত্রে তাওয়ের প্রভাব বিস্তার করার জন্য ধ্যানযোগের আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ধ্যানযোগ হল তাওপন্থী সাধকের অপরিহার্য সাধনমার্গ।  তাওপন্থীরা তাঁদের মৌলিক ধারণাগুলি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাও গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি জানেন তিনি মৌন থাকেন, আর যিনি কথা বলেন তিনি জানেন না। তাও মতানুসারে, যিনি সঠিক ধ্যানযোগের সাধনমার্গ অবলম্বন করেন, তাঁকে প্রেম-ঘৃণা, লাভ- ক্ষতি, নিন্দা-স্তুতি -কোনও কিছুই স্পর্শ করে না। তাওবাদীরা প্রাণায়াম ইত্যাদি যোগের বহিরঙ্গ সাধনার বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।

  • ইয়াং’ ও ‘ইন’: তাও ধর্মগ্রন্থে এই বহিরঙ্গ সাধনার সঙ্গে ইয়াং (Yang, পুরুষের ধর্মবিশিষ্ট সক্রিয় জীবন) ও ইন (Yin, স্ত্রী গুণবিশিষ্ট স্থূল প্রকৃতি)-এর সম্বন্ধের কথাও বলা হয়েছে।

(5) প্রশাসনিক দর্শন: প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও তাওবাদে নিষ্ক্রিয়তার তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। তাওবাদী দার্শনিকের মতে, রাজা দেশশাসন করবেন হস্তক্ষেপ ছাড়াই। প্রশাসনের নিয়মকানুন মানবজীবনের স্বাভাবিক গতিপথে বাধাস্বরূপ। কারণ- রাজদণ্ড যত কঠোর হবে, তত বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ যত কম হবে, দেশে ততই শান্তি বিরাজ করবে। এ ছাড়া তাও তত্ত্বে শাসক শ্রেণিকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

যথা- (a) মানুষ যে শাসকের কেবল অস্তিত্বটুকু জানে, তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ  শাসক ।

(b) যিনি প্রজার প্রীতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন, তিনি হলেন সুশাসক।

(c) যাঁর ভয়ে প্রজারা ভীতসন্ত্রস্ত, সেই শাসক থাকেন এর নিম্নস্থানে এবং

(d) সকলেই সর্বদা যাঁর নিন্দা করেন, তিনি সবার নীচে অবস্থান করেন।

পরিশেষে বলা যায়, নৈতিক বিধি, সরল জীবনাদর্শ, সদগুণের অনুশীলনের ক্ষেত্রে তাওবাদ আদর্শস্থানীয় একটি দর্শনরূপে পরিগণিত হয়েছে।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment