দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এই বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যাপক, বিধ্বংসী ও ভয়াবহ ছিল।
 
সুস্বাগতম প্রিয় শিক্ষার্থী। Prayaswb -এর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আপনাদের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে আলোচনা করবো।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ পড়ে নেওয়া যাক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

ভূমিকা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এই বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যাপক, বিধ্বংসী ও ভয়াবহ ছিল। এই যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ কোটি, আহত প্রায় চার কোটি এবং বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই কোনও না কোনওভাবে এই মহাযুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই মহাযুদ্ধের পেছনে নানা কারণ ছিল।

ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ বনাম গণতান্ত্রিক আদর্শের সংঘাত

বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শগত সংঘাত বহুলাংশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথকে প্রশস্ত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পরেই বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলি দুটি পরস্পরবিরোধী আদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে ছিল একনায়কতন্ত্র, অন্যদিকে গণতন্ত্র। জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদ এবং ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল একদলীয় একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ১৯৩৭ সালে জার্মানি-ইতালি ও জাপানকে নিয়ে গড়ে ওঠে অক্ষশক্তি (Axis Power)। গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি তাদের সীমাহীন ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছিল। অন্যদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ছিল গণতন্ত্র ও সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার সমর্থক। রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে রাশিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পশ্চিমী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ও নাৎসি গোষ্ঠী – দু’পক্ষই বুশ সাম্যবাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিল। রাশিয়াকে তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু কাল ব্রাত্য হয়ে থাকতে হয়েছিল। নাৎসি-জার্মানির আশু আক্রমণ সম্ভাবনা থেকে আত্মরক্ষার উপায় হিসাবে রাশিয়া জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করে (১৯৩৯ খ্রিঃ)। ফলে রাশিয়া কিছুকাল যুদ্ধ এড়িয়ে চলেছিল। অবশেষে দু বৎসর যুদ্ধ চলার পর নাৎসি-জার্মানি রাশিয়া আক্রমণে উদ্যোগী হলে রাশিয়া পশ্চিমী গণতান্ত্রিক শিবিরে যোগদান করে। সেই সময়ে পশ্চিমী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিরও বুশ সাহায্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। বস্তুতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এই দিক থেকে গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের দ্বন্দু হিসেবে গণ্য করা চলে। অক্ষশক্তি গঠনকালে (১৯৩৭) ফ্যাসিবাদী ইতালির কর্ণধার মুসোলিনির একটি বহু উদ্ধৃত উক্তিতে এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। উক্তিটি হল- “দুই জগতের এই দ্বন্দ্বে আপসের কোন স্থান নেই। আমরা, নয় ওরা।”

ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অনেকেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভার্সাই সন্ধিকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মতে, ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভার্সাইয়ে সমবেত নেতৃমণ্ডলী নিছক প্রতিশোধ-স্পৃহা দ্বারা পরিচালিত হয়ে পরাজিত জার্মানির উপর এই অপমানজনক চুক্তি চাপিয়ে দেয়। ই. এইচ. কার এই চুক্তিকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ‘জবরদস্তিমূলক চুক্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। 
  • চুক্তি স্বাক্ষরকালে জার্মান প্রতিনিধিদের কোনোরকম মতামত প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে সম্পূর্ণ ভীতির পরিবেশে তাঁদের এই চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। এর ফলে এই ‘একতরফা চুক্তি’ পালন করার কোনও নৈতিক দায়িত্ব জার্মানি বোধ করে নি। 
  • এই চুক্তির অধিকাংশ শর্তই ছিল জার্মানির পক্ষে অতি অমর্যাদাকর এবং সেগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিকে হীনবল ও পঙ্গু করে রাখা। একতরফাভাবে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মান জাতির উপর যে বিশাল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা দেওয়ার ক্ষমতা জার্মানির ছিল না। ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড়াও জার্মানি মিত্রপক্ষকে লোহা, কয়লা, রবার প্রভৃতি কাঁচামাল সরবরাহ করতে বাধ্য হয় এবং তার শিল্পসমৃদ্ধ সার অঞ্চলের উপর ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ক্ষতিপূরণের বোঝা জার্মানির বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেয়। জার্মানির উপনিবেশগুলি কেড়ে নিয়ে, সেগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়ার পরিবর্তে মিত্রপক্ষীয়রা তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। 
  • জার্মানির সামরিক শক্তি হ্রাস করে জার্মানিকে ক্ষুদ্র দেশ বেলজিয়ামের চেয়েও হীনবল করা হয়। 
  • মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ‘চোদ্দো-দফা শর্তে’ যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা জার্মানির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় নি, বরং বহু জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চলকে জার্মানি থেকে বিচ্ছিন্ন করে চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এইভাবে ভার্সাই সন্ধি দ্বারা জার্মানি প্রায় ২৫ হাজার বর্গমাইল এলাকা, ৭০ লক্ষ অধিবাসী, শতকরা ১৫ ভাগ কর্ষণযোগ্য ভূমি এবং শতকরা ১২ ভাগ শিল্পকেন্দ্র থেকে বঞ্চিত হয়। জার্মানির পক্ষে এই অসম্মানজনক ও মর্যাদাহানিকর চুক্তি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। জার্মান জনমানস তাই শুরু থেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করতে থাকে। হিটলার ও নাৎসি দল এই চুক্তির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং একের পর এক এর শর্তাদি লঙ্ঘন করতে থাকেন। অনেকে তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ‘হিটলারের যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন। ই. এল, উডওয়ার্ড বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হল হিটলারের যুদ্ধ। তিনি এই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন, তিনিই যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনিই পরাজিত হয়েছিলেন।” বলা বাহুল্য, হিটলারের অনেকগুলি দাবিই ছিল ন্যায্য। জার্মানির ন্যায্য দাবিগুলি পুরণ করে জার্মানিকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের সীমানায় • ফিরিয়ে দিলেই জার্মানি সন্তুষ্ট হত।

সাম্রাজ্যবাদী স্পৃহা ও প্রয়াস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধানতম কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির উপনিবেশ ও প্রভাববলয় পুনর্বণ্টন প্রচেষ্টার মধ্যে খুঁজতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী শক্তিগুলি ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা সারা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিয়েছিল। অন্যদিকে পরাজিত জার্মানিকে তার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য হারাতে হয়েছিল। বিজয়ী ইতালি লন্ডনের গোপন চুক্তি (১৯১৫ খ্রিঃ) অনুযায়ী প্রতিশ্রুত ভূখন্ড প্যারিস সম্মেলনে (১৯১৯খ্রিঃ) লাভ করেনি। বিজয়ী জাপানও চীনে যা পেয়েছিল তাতে তৃপ্ত হয়নি। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের জনস্ফীতির জন্য স্থান সঙ্কুলান ও শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও পণ্যের বাজারের দরকার ছিল। সুতরাং নাৎসি জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের জার্মান উপনিবেশগুলির প্রত্যর্পণের দাবিতে সোচ্চার হয়। ইতালি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকায় নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজ প্রাধান্যস্থাপনে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি উপনিবেশ বণ্টন নীতি মেনে নিতে রাজি ছিল না। অতৃপ্ত জার্মানি ইতালি জাপান শক্তি প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করে। প্যারিসের ব্যবস্থা (১৯১৯ খ্রিঃ) এদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। সুতরাং তার পরিবর্তনে তারা উচ্চকণ্ঠ হয়। অন্যদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্যারিসের শান্তির ফলে সমৃদ্ধ হয়েছিল। অতএব তারা এই পরিবর্তন বিরোধী ছিল। এইভাবে পৃথিবী দুটি পরস্পর-বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে জার্মানি-ইতালি-জাপানের অক্ষশক্তি (১৯৩৭ খ্রিঃ) জোট।

সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের পুনরভ্যুদয়

প্যারিসের শান্তি ব্যবস্থার রচয়িতারা সচেতন ছিলেন যে, সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্খা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য কিছু পরিমাণে দায়ী ছিল। তাই জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি স্বীকৃত হয়েছিল। আবার জাতীয় আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার নীতি গ্রহণে সমদৃষ্টি অবলম্বিত হয় নি বা বাস্তব অসুবিধায় বহু ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা যায়নি। এর ফলে যুদ্ধোত্তর ইউরোপে বহু স্থানে জাতীয় সংখ্যালঘু সমস্যার সৃষ্টি হয়। পুরোন অন্যায়ের প্রতিকার করতে গিয়ে নতুন অন্যায়ের উদ্ভব ঘটে যায়। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ঘটেছিল জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে। এর ফলে জার্মান জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দেয়। জার্মান জাতীয়তাবাদীরা ইউরোপের জার্মান ভাষাভাষী সকলকে রাইখের অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক হয়। তারা অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল, মেমেল, ডানজিগ, পোলিশ করিডর জার্মানির সঙ্গে সংযুক্তিকরণে উদ্যোগী হয়। জার্মানির মতো ইতালীয় ফ্যাসিস্তরা ইতালীয়ান ভাষাভাষী অঞ্চল কর্সিকা, স্যাভয়, নিস প্রভৃতি নিজেদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক হয়। রাশিয়া রুশ ভাষাভাষী অঞ্চল শ্বেত-রাশিয়া, লিটল-রাশিয়া প্রভৃতি স্থানগুলি পুনরুদ্ধারের আশা পরিত্যাগ করেনি।

প্রত্যক্ষ কারণ

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার উপলব্ধি করেন যে, ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ আসন্ন। এই যুদ্ধে যাতে রাশিয়া ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে যোগ দিতে না পারে, সেজন্য হিটলার রাশিয়ার সঙ্গে দশ বছরের অনাক্রমণ চুক্তি (আগস্ট, ১৯৩৯ খ্রিঃ) সম্পাদন করেন। বুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিনও বিশেষ পরিস্থিতিতে এই চুক্তি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। অতঃপর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ৩রা সেপ্টেম্বর ইঙ্গ-ফরাসি জোট পোল্যান্ডের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment