দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ গুলি আলোচনা করো

ভূমিকা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হতাশা ও ক্লান্তির রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই ২০ বছরের মধ্যেই আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতার করাল ছায়া বিশ্বকে গ্রাস করে। আসলে দুই বিশ্বযুদ্ধে মধ্যবর্তীকালীন ঘটনাবলী এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ

ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি: ঐতিহাসিক টেলর এর মতে, ভার্সাই সন্ধির ত্রুটির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে সামরিক উপনিবেশিক, অর্থনৈতিক-সব দিক দিয়েই – পঙ্গু করে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তা জার্মানদের আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। জার্মানির নাতসিদল প্রচার করে যে, জার্মানির যাবতীয় সংকটের মূলে ছিল ভার্সাই সন্ধি। তাই জার্মানিরা ভার্সাই সন্ধি নাকচ করে অপমানের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিল।

অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ: প্যারিসের শান্তি সম্মেলনের (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) পর থেকে জার্মানি, জাপান, ইটালি-এই তিনটি দেশ নিজেদেরকে ‘অপরিতৃপ্তের দেশ’ বলে মনে করত। ফলে সাম্রাজ্য ক্ষুধার জ্বালায় এই তিনটি শক্তি সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় মেতে ওঠে। ফলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয়।

জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদ:
হিটলারের ‘হেরেনফোক তত্ত্ব’ থেকেই উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল-যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদের নেশায় হিটলার অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ডের জার্মান ভাষাভাষী অধিবাসীদের নিয়ে বৃহত্তর জার্মান সাম্রাজ্য গঠনে বদ্ধপরিকর ছিল।

নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা:
১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে অস্ত্র হ্রাসের প্রশ্নে ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির মতানৈক্য ঘটে। ফলে জার্মান প্রতিনিধিরা সম্মেলন বয়কট করে এবং জার্মানি লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করে অস্ত্রসজ্জায় ব্রতী হয়।

জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতি: ‘এশিয়া এশিয়াবাসীর জন্য’-জাপানের এই উক্তির মধ্যেই তার এশিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপনের তত্ত্ব লুকিয়ে ছিল-যা মিত্রশক্তিকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রথম শিকার হয় মাঞ্চুরিয়া (১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ) এবং ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার চিন আক্রমণ এশিয়ার শান্তিকে ধ্বংস করে।

ইটালির আগ্রাসন নীতি: ইতালির সর্বাধিনায়ক মুসোলিনি ইটালিকে বিশ্বসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত করার – জন্য আগ্রাসন ও পররাজ্যগ্রাস নীতি গ্রহণ করে-যা বিশ্বকে – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। মুসোলিনির আগ্রাসন নীতির প্রথম প্রয়োগ হয় আবিসিনিয়ায়।

উপনিবেশিক স্বার্থ সংঘাত: বৃহত্তর শক্তিগুলির উপনিবেশ বিস্তারের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির দখলে চলে যায়। মুশকিল হয়েছে জার্মানি, ইটালি ও জাপানের, তাদের ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। ভোজের শেষবেলায় এসে তারা পাত কাড়াকাড়ি করলে উপনিবেশিক স্বার্থসংঘাত দেখা যায়-যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

দুই শক্তিজোট: দ্বিতীয় বিশ্বের পূর্বে সমগ্র বিশ্ব দুটি সামরিক শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে জার্মানি, জাপান ও. ইটালিকে নিয়ে অক্ষশক্তি জোট এবং অপরদিকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মিত্র জোট। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তি জোটে যোগ দেয়। এই পরস্পর বিরোধী জোট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র রচনা করেছিল।

তোষণ নীতি: হিটলার ও মুসোলিনির আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির প্রভাবে ইউরোপে যুদ্ধ উন্মাদনা যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি সাম্যবাদ ভীতি ও শান্তি অব্যাহত রাখার কারণে জার্মানি ও ইটালিকে তোষণ করতে থাকে। ফলে তাদের রাজ্যগ্রাস ক্ষুধা বেড়ে যায়। এই রাজ্যগ্রাস ক্ষুধার জ্বালায় হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তাই তোষণ নীতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ।

জাতিসংঘের ব্যর্থতা: আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তিরক্ষায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। দুর্বল দেশগুলি তাদের ওপর আক্রমণের প্রতিকারস্বরূপ নালিশ জানালেও জাতিসংঘ আক্রমণকারী দেশের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তার এই ব্যর্থতার কারণগুলি হল-(১) সাংগঠনিক ত্রুটি, (২) নিজস্ব সেনাবাহিনীর অভাব, (৩) বৃহৎ শক্তিবর্গের অনুপস্থিতি (৪)  সদস্য রাষ্ট্রের ভেটো প্রয়োগ প্রভৃতি যার পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

প্রত্যক্ষ কারণ: ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ইঙ্গ-ফরাসির শক্তির সর্তকতা উপেক্ষা করে পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। এরই প্রতিবাদে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি ও ৩ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের পক্ষ নিয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

Leave a Comment