‘নব্য রাজতন্ত্র’ বলতে কী বোঝ এবং ইংল্যান্ডে সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে কেন ‘নব্য রাজতন্ত্র’ বা ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বলা হয়

‘নব্য রাজতন্ত্র’ বলতে কী বোঝ এবং ইংল্যান্ডে সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে কেন ‘নব্য রাজতন্ত্র’ বা ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বলা হয়

অথবা, সপ্তম হেনরি প্রবর্তিত নব্য বা নতুন রাজতন্ত্রের মূল্যায়ন করো

'নব্য রাজতন্ত্র' বলতে কী বোঝ এবং ইংল্যান্ডে সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে কেন 'নব্য রাজতন্ত্র' বা 'নতুন রাজতন্ত্র' বলা হয়
‘নব্য রাজতন্ত্র’ বলতে কী বোঝ এবং ইংল্যান্ডে সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে কেন ‘নব্য রাজতন্ত্র’ বা ‘নতুন রাজতন্ত্র’ বলা হয়

ভূমিকা

১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডে টিউডর রাজবংশের শাসনের সূচনা করেন। তিনি বসওয়ার্থের যুদ্ধে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৃতীয় রিচার্ডকে পরাস্ত করে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। ফলে ইংল্যান্ডের ত্রিশ বছর দীর্ঘস্থায়ী গোলাপের যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং সপ্তম হেনরির নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে একটি নতুন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত এই রাজতন্ত্রকে ‘নব্য রাজতন্ত্র’ (New Monarchy) বলে অভিহিত করা হয়।

নব্য রাজতন্ত্রের ধারণা

ঐতিহাসিক জে আর গ্রিন (JR Green) সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে সর্বপ্রথম New Monarchy বা নব্য রাজতন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে রিচার্ড স্টোরি, এ হ্যালাম প্রমুখ ঐতিহাসিকগণও একে নব্য রাজতন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। এইসকল ঐতিহাসিকদের মূল বক্তব্য হল, ইংল্যান্ডের দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডে একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে অরাজক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে একটি নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাই ঐতিহাসিক ডি এল কেয়ার বলেছেন যে, “সপ্তম হেনরির সময় থেকেই ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।” তাঁর রাজত্বকালে ইংল্যান্ডে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিত্যনতুন পদক্ষেপ ও সংস্কারসাধন করা হয়। এজন্য সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রকে নব্য রাজতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

নব্য রাজতন্ত্র বলার কারণ

সপ্তম হেনরির আমল থেকে ইংল্যান্ডে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তনের সূচনা হয়। যথা-

(1) নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: সপ্তম হেনরি সিংহাসন আরোহণের পর রাজার ক্ষমতাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ এবং সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের ভিত্তিপ্রতিষ্ঠা করেন। তাই ঐতিহাসিক ডি এল কেয়ার সহ অনেকেই বলেছেন সপ্তম হেনরির সময়কাল থেকেই ইংল্যান্ডে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তী রাজা অষ্টম হেনরি ও তাঁর মন্ত্রী টমাস ক্রমওয়েলের সময়কালে তা পূর্ণতা পায়।

(2) শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা: সপ্তম হেনরির সিংহাসন আরোহণের মধ্যে দিয়ে ইংল্যান্ডে দীর্ঘকাল ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলছিল, তার অবসান ঘটে। রাজার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ইংল্যান্ডে ধীরে ধীরে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে।

(3) সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা হ্রাস: সপ্তম হেনরি অনুভব করেছিলেন ব্যারন বা সামন্তপ্রভুদের কর্তৃত্ব ইংল্যান্ডে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান বাধা। কেন-না এই ক্ষমতাবান সামন্তপ্রভুরা প্রশাসনের নানা জটিলতা সৃষ্টি করতেন। তাই প্রথম থেকেই ব্যারন বা সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে তিনি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যথা-

  • তিনি অ্যাটেন্ডারের মাধ্যমে সামন্তপ্রভুদের নানাভাবে অভিযুক্ত করে তাঁদের জমি বাজেয়াপ্ত করেন।
  • ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি রাজবংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কস্থাপন করে টিউডর রাজবংশের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।

(4) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: সপ্তম হেনরি রাজকোশের আর্থিক সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যথা-

  • তিনি রাজার নিজস্ব খাস জমি ছাড়াও সামন্ত অভিজাতদের থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ভূমিরাজস্ব আদায় করেন।
  • তিনি আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যের ওপর টানেজ ও পাউন্ডেজ নামক দুই ধরনের শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা করেন।
  • অভিজাতদের থেকে দান ও জবরদস্তি ঋণ গ্রহণের পাশাপাশি আদালতে দোষী সাব্যস্ত সামন্তপ্রভুদের কাছ থেকে আর্থিক জরিমানার মাধ্যমে রাজকোশকে সমৃদ্ধ করেন।

(5) পার্লামেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি: সপ্তম হেনরি প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের নতুনত্ব হল পার্লামেন্টের অভূতপূর্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি। তিনি পার্লামেন্টকে রাজার আজ্ঞাবাহী যন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। পার্লামেন্টে ‘রিজাম্পশন আইন’ পাস করে তিনি একদিকে যেমন রাজার খাস জমি পুনরুদ্ধার করেছিলেন, তেমনি ‘লিভ্যারি’ ও ‘মেইনটেনেন্স’ বিরোধী আইন পাস করে সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতাও খর্ব করেছিলেন।

(6) বিচারব্যবস্থার উন্নতি: টিউডর রাজবংশ প্রতিষ্ঠার আগে ইংল্যান্ডের বিচারব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। সপ্তম হেনরি বিচার বিভাগের নানা সংস্কারসাধন করেন। ফলে বিচার বিভাগের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে।

(7) সামাজিক পরিবর্তন: প্রশাসনের উচ্চপদগুলিতে সামন্ত অভিজাতদের পরিবর্তে সপ্তম হেনরি মধ্যবিত্তদের নিয়োগ করেন। এইভাবে অভিজাত শ্রেণির মর্যাদা হ্রাস পায় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ইংল্যান্ডের সামাজিক পরিবর্তন ঘটে।

মূল্যায়ন

উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সবশেষে বলা যায় যে, সপ্তম হেনরি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দ্বারা ইংল্যান্ডে একটি নতুন রাজতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক এলটন, রোজার লোকিয়ার প্রমুখরা মনে করেন যে, সপ্তম হেনরি রাজতন্ত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনেননি। তিনি পুরানো ব্যবস্থাকেই পুনরুদ্ধার করেছিলেন মাত্র। তথাপি এ কথা সত্য যে, সপ্তম হেনরি পুরানো শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর সংস্কার করে এক নতুন ধরনের রাজতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment