নভেম্বর বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা চিহ্নিত করো

নভেম্বর বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা চিহ্নিত করো
নভেম্বর বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা চিহ্নিত করো।

ভূমিকা

রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব দুটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছিল, যথা- ‘মার্চ বিপ্লব’ এবং ‘নভেম্বর বিপ্লব’। একথা ঠিক যে, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ‘মার্চ বিপ্লবে’র সময় লেনিন অনুপস্থিত ছিলেন তাই মার্চ বিপ্লবে তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না, কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবে লেনিনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল এবং তাঁরই রণকৌশলের ভিত্তিতে নভেম্বর বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল।

[১] লেনিনের প্রত্যাবর্তন ও এপ্রিল থিসিস: জনগণের বিক্ষোভকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে পরিচালিত করাই ছিল বলশেভিক দলের উদ্দেশ্য। এপ্রিল মাসে বলশেভিক দলের নেতা লেনিন সুইজারল্যান্ড থেকে রাশিয়ায় ফিরে আসেন এবং রাশিয়ার জনগণের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য তিনি ‘এপ্রিল থিসিস’ ঘোষণা করেন (১৬ এপ্রিল, ১৯১৭ খ্রি.)। ‘এপ্রিল থিসিস’-এ তিনি- ১ মার্চ বিপ্লবে সোভিয়েতগুলির প্রধান ভূমিকা ছিল, তাই সব ক্ষমতা সোভিয়েতগুলির হাতে প্রদানের দাবি করেন; ২ সোভিয়েতগুলির হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা আসার পর বলশেভিকদের কাজ হবে ‘সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা এবং এই উদ্দেশ্যে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা; উৎপাদন ব্যবস্থা, বণ্টনব্যবস্থা ও ব্যাংকগুলির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন করা; ৩ রুশ জনগণের বহুদিনের দাবি-“শান্তি, খাদ্য ও জমি” পূরণ করা হবে। অর্থাৎ যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি স্থাপন, শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ এবং কৃষকদের মধ্যে জমির বন্দোবস্ত করাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। এইভাবে লেনিন সেনা, শ্রমিক ও কৃষক এই তিনশ্রেণির মানুষের প্রকৃত কল্যাণসাধনের কথা ঘোষণা করেন।

[২] পেট্রোগ্রাডে বিক্ষোভ মিছিল: ইতিমধ্যে মার্চ বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের তত্ত্বাবধায়ক কেরেনস্কি জার্মানদের বিরুদ্ধে পুনরায় আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করেন। কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় (জুলাই, ১৯১৭ খ্রি.) সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ বৃদ্ধি পায় এবং জনগণ সোভিয়েতগুলির দ্বারা সংগঠিত হতে থাকে, এমনকি যুদ্ধনীতির প্রতিবাদে বলশেভিক দলের নেতৃত্বে পেট্রোগ্রাডে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয় (জুলাই, ১৯১৭ খ্রি.)। শ্রমিক মিছিলের উপর অত্যাচার শুরু হলে লেনিনসহ বহু নেতৃস্থানীয় কর্মী আত্মগোপন করেন। এইসব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও শহরে, গ্রামাঞ্চলে ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বলশেভিক দলের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং আলোচ্য সময়ে বলশেভিক দলের সদস্য সংখ্যা ৫০,০০০ থেকে ২৪০,০০০-এ পরিণত হয়।

[৩] পেট্রোগ্রাড সোভিয়েত বলশেভিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা : পেট্রোগ্রাড সোভিয়েতে বলশেভিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সংসদীয় প্রজাতন্ত্র ও মধ্যবিত্তশ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেনিন শ্রমিক, সেনা ও কৃষকদের প্রতিনিধি হয়ে সংঘ স্থাপনের নীতি ঘোষণা করেন। তাঁর নেতৃত্বে বলশেভিক দল ‘শান্তি, খাদ্য ও জমি’ এই তিনটি বিষয়ের উপর জনমত গঠন করতে থাকে। মেনশেভিক সরকারের ব্যর্থতার সুযোগে তারা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা শ্রমিক-সেনা প্রতিনিধিদের সোভিয়েতের হাতে হস্তান্তর করার জন্য বলশেভিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

[৪] লেনিন কর্তৃক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তাব: অক্টোবর মাসে বলশেভিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ঐতিহাসিক অধিবেশনে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য লেনিনের প্রস্তাব ১০-২ ভোটে গৃহীত হয়। অবশেষে লেনিনের যোগ্য শিষ্য ট্রটস্কি ২৫,০০০ সশস্ত্র শ্রমিক নিয়ে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর বলশেভিক দলের নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত করে এবং অস্থায়ী সরকারের পতন হয়।

ঐতিহাসিক এইচ. এ. এল. ফিশার বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনে লেনিনকে ‘অবতার’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর ভাষায় “Lenin was its prophet and the Com- munist Party its church”।

Leave a Comment