![]() |
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র ও যুবসমাজের করণীয় রচনা |
ভূমিকা
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-“আমি কিন্তু সবচেয়ে কম করিয়াই বলিতেছি, কেবলমাত্র লিখিতে পড়িতে শেখা, তাহা কিছু লাভ নহে, তাহা কেবলমাত্র রাস্তা। এই রাস্তাটা না হইলেই মানুষ আপনার কোণে আপনি বন্ধ হইয়া থাকে।” শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ। এই বিকাশ যত ত্বরান্বিত হবে দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি তত উন্নত হবে। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের মানুষ মানসিকভাবে উন্নত ও চিন্তায় সংযত ছিল। কিন্তু মধ্যযুগে শিক্ষার ক্ষেত্রে নেমে এল কালো অন্ধকার। আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও ভারতবর্ষের সমগ্র জনসমাজের এক বিরাট অংশ অক্ষরজ্ঞানহীনতার অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। ছাত্র ও যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে তাই এই সমস্যার সমাধানে।
নিরক্ষরতার কারণ
অন্ধ লোক যেমন প্রকৃতির আলো থেকে বঞ্চিত তেমনি নিরক্ষর লোকেরাও সমাজের অগ্রগতি থেকে বঞ্চিত। ভারতবর্ষের এখনো দুই-তৃতীয়াংশ লোক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। যে কারণে দেশের সার্বিক অগ্রগতি আজ ব্যাহত।
ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারত দীর্ঘদিন থাকার ফলে শিক্ষার সঠিক বিকাশ হয়নি। তারা ভারতবাসীকে দমন করে রাখবার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার উপযুক্ত উন্নয়ন করেন নি। ফলে ভারতে শিক্ষার হার খুব কম। দ্বিতীয়ত, জীবনযাত্রার মানও শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। দরিদ্রদের মধ্যে শিক্ষার প্রবণতা কম। শিক্ষার জন্য ব্যয় বেশি হওয়া তাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র। তৃতীয়ত, নারীদের মধ্যে শিক্ষা সম্পর্কে কুসংস্কার রয়েছে বলে তারা শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। আবার মুসলমান সমাজ নারী শিক্ষা বিরোধী বলে তাদের ক্ষেত্রেও নারী শিক্ষার হার কম। চতুর্থত, আমাদের দেশ স্বল্পোন্নত বলে আমাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার কম। আজ ভারতের কৃষককেও নবযুগের কৃষি- বিজ্ঞানের মূল তত্ত্বগুলি জানতে হবে; কুটির-শিল্পীকে, দোকানদারকে, এমন-কি একজন মুচিকেও নবযুগের বৈজ্ঞানিক আবিষ্করণ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে হবে। শিক্ষার দাওয়াই তো আজও মৃতের মুখে ওষুধ ঢালার মতোই আত্মসান্ত্বনা অথবা আত্মপ্রবঞ্চনা। ভুলের মাশুল গুণে গুণে ঋণের পরিমাণ শুধু বেড়েই চলেছে-‘দেশের মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।’ পঞ্চমত, সাক্ষরতা অভিযানে নিরক্ষর ব্যক্তি নিজেকে ব্রাত্য মনে করে। ষষ্ঠত, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এখনও নিজেদের জানে না, নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কারণগুলি সম্পর্কেও আদৌ সচেতন নয়। সেজন্য পারস্পরিক লেনদেনের প্রয়োজনে চাই যাতায়াতের পথ-‘সেটা যদি রাজপথ না হয় তো অন্তত গলিরাস্তা হওয়া চাই।’ সাক্ষরতা অভিযানই সেই পাড়াগেঁয়ে মেটে পথ।
ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের ভূমিকা
যারা অল্পবয়সী, নবচেতনায় জাগরিত, এগিয়ে চলাই যাদের একমাত্র মন্ত্র, যাদের কোনো পিছু টান নেই তারাই হল এই ছাত্র-যুবসমাজ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সবুজের অভিযান’ কবিতায়, সুকান্ত তাঁর ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় এদের বন্দনা করেছেন। তাদের লক্ষ্য সমাজকে শোষণ মুক্ত করা, মানুষকে শোষণ থেকে উদ্ধার করা এবং সমাজকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা। তাদের সাক্ষরতা অভিযানে এগিয়ে আসতে হবে এবং জ্ঞানের মশাল ছড়িয়ে দিতে হবে। বিভিন্ন দেওয়াল লিখন, সভা-সমিতি করা, রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করা প্রভৃতি কাজে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। নিরক্ষর মানুষরা যাতে শিক্ষার আলো দেখতে পায় তার জন্য তাদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিতে হবে। এ সমস্ত প্রচারের ভার তো ছাত্র-যুবসমাজেরই। আমাদের দেশের চল্লিশ শতাংশ ছাত্র-যুবসমাজ যদি নিরক্ষরতা দূরীকরণে এগিয়ে আসে, তাহলে নতুন প্রভাতের উদয় হবেই।
উপসংহার
ইতিহাস শিক্ষা মানে যেমন মোগল সম্রাটদের নামাবলী মুখস্থ করা নয়, শিক্ষা মানেও তেমনি ক্লাসে বসে কিছু তত্ত্বকথার আবৃত্তি নয়। জীবনে যা প্রয়োজনীয়, যে-শিক্ষা জোগায় প্রতিদিনের স্বনির্ভর বাঁচার রসদ, যে-শিক্ষা জীবনে বন্ধু, দুর্দিনে পথিকৃৎ, আমরণ প্রভুর মতো চালিকাশক্তি, সে-শিক্ষাই স্বাধীন দেশে কাম্য। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, নিরন্ন পরিবারে অক্ষর-জ্ঞান অপেক্ষা অন্নের মূল্য বেশি। দারিদ্র্য-দোষ সর্বগুণ নাশ করে। সমাজ কাঠামোর মধ্যে ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য বর্তমানে খুব বেশি। দ্বিতীয়ত, সমাজ সর্বত্র অকারণ বিলাস-বিভ্রম জাতীয় সম্পদ নাশ করে। তৃতীয়ত, লোকশিক্ষার মধ্যে কোনোপ্রকার আত্মগর্ব প্রচার-স্পর্শ থাকলে সে শিক্ষায় লোকসমাজ বীতস্পৃহ হয়। সুতরাং, মানুষকে তার মনুষ্যত্বের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্যেই সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রচার করতে হবে। কবির সেই সাবধানবাণী স্মরণযোগ্য-
তাই নিরক্ষরতা সমস্যার সার্বিক উপলব্ধি ও তা দূরীকরণ আমাদের আশু লক্ষ্য ও অবশ্য কর্তব্য হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে ছাত্র ও যুব সমাজকে।