ন্যায়ের উৎসগুলি আলোচনা করো

ন্যায়ের উৎস
অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার ন্যায়ের উৎস সম্পর্কে যেসকল বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন, সেই বিষয়গুলি হল-ধর্ম (Religion), প্রকৃতি (Nature), অর্থনীতি (Economy) এবং নীতিশাস্ত্র (Ethics) I
(i) ধর্ম
মধ্যযুগে ধর্মযাজকগণ মনে করতেন যে, ঈশ্বরচর্চার মধ্য দিয়ে ন্যায় তথা যথার্থবোধের ধারণা জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। ন্যায়ের ভিত্তিই হল ধর্ম। এ প্রসঙ্গে সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস বলেছেন, ধর্মই ন্যায়ের মান সরবরাহ করে থাকে এবং সেই মানই রাষ্ট্রগুলির আইনকে অনুপ্রেরণা দেয় ও নিয়ন্ত্রণ করে।
(ii) প্রকৃতি
প্রকৃতির ধারণাটি ন্যায়ের উৎসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ন্যায় বা আইন বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, বিষয়সমূহের প্রাকৃতিক বিন্যাসের সঙ্গে মূল্যবোধ যুক্ত হয়ে ন্যায়নীতির সৃষ্টি হয়। স্টোয়িক দার্শনিকগণ থেকে শুরু করে সামাজিক চুক্তিবাদী দার্শনিকগণের কাছে ন্যায়ের অন্যতম উৎসরূপে প্রকৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁরা প্রকৃতি বলতে একটি নীতিকে চিহ্নিত করেছেন, যার দ্বারা বিশ্বসংসার নিয়ন্ত্রিত হয় বলে দাবি করা যায়। অধ্যাপক বার্কার-এর মতে, ন্যায়ের উৎস হিসেবে যে প্রকৃতির কথা বলা হয়, তা ধর্মবিশ্বাস ও নৈতিক দর্শন থেকে আলাদা নয়। ন্যায়ের এই প্রাকৃতিক ধারণা ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিক দর্শনের সঙ্গে যুক্ত।
(iii) অর্থনীতি
কোনো কোনো রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অর্থনীতিকে ন্যায়ের অন্যতম উৎসরূপে চিহ্নিত করেছেন। বস্তুবাদী তাত্ত্বিকগণ মনে করেন, বাস্তব অর্থনৈতিক ঘটনাগুলি থেকেই ন্যায়ের উৎপত্তি ঘটেছে। ন্যায়ের ধারণাই হল অর্থনৈতিক নীতিসমূহের সিদ্ধান্ত। কারণ, সমাজে যারা আর্থিক দিক থেকে সংগতিসম্পন্ন ও প্রভাবশালী তারাই দুর্বল শ্রেণির উপর আইন বলবৎ করে। এর ফলে ন্যায়ের ধারণাটি সংগতিসম্পন্ন শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক শক্তিই এখানে ন্যায়ের উৎস। তবে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হলে ন্যায়ের এই ধারণার বদল ঘটবে।
(iv) নীতিশাস্ত্র
নীতিশাস্ত্রকে ন্যায়ের অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অধ্যাপক বার্কার। তাঁর মতে, জনগণের নৈতিক মান সাধারণ নৈতিক চেতনা থেকে উদ্ভূত হয়। ন্যায়ের ধারণার মধ্যে মূল্যবোধভিত্তিক ব্যবস্থা নিহিত থাকে, যা রাষ্ট্রীয় আইনের অন্যতম উৎসরূপে পরিচিত। নীতিশাস্ত্র থেকেই ন্যায়ের অনুশাসনের উৎপত্তি হয়। তবে, পরবর্তীকালে বার্কার নীতিশাস্ত্রকে ন্যায়ের একমাত্র উৎস হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি থেকে পিছিয়ে এসেছেন। তার কারণ, তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, ন্যায় মানুষের বহির্জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিন্তু তার অন্তর্জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অথচ মানুষের অন্তর্জীবন বহির্জীবনের আচরণবিধির সঙ্গেই গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
উপরোক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায়, ন্যায়ের প্রকৃত উৎস হল প্রজ্ঞা। প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই প্রজ্ঞা গড়ে ওঠে সামাজিক চেতনা থেকে। আবার, এই সামাজিক চেতনা যেহেতু সদা পরিবর্তনশীল, তাই মানুষ সবসময় প্রগতিশীল ধারণাকে গ্রহণ করতে সচেষ্ট থাকে। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে ন্যায়ের কোনো একক উৎস পরিলক্ষিত হয় না।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর