পরিবেশ রক্ষার সমস্যা রচনা

পরিবেশ রক্ষার সমস্যা রচনা
পরিবেশ রক্ষার সমস্যা রচনা

ভূমিকা

সৃষ্টি ও বিনাশের মধ্যে রয়েছে স্থিতি। এই স্থিতি হল রক্ষা এবং অবশ্যই তা সুরক্ষা। সৃষ্ট বা বিনাশ সাময়িক সময়ের ব্যাপার, কিন্তু রক্ষা শুধু দীর্ঘকালীন নয়, তা সুকঠিনও বটে। পরিবেশ রক্ষাও তা-ই। বিগত শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও ইংরেজের অর্থনৈতিক শোষণ এবং বিশ্বায়নের কল্যাণে মানবজীবনে নানান বস্তুগত উন্নতি সত্ত্বেও আমাদের পরিবেশের ও মানসিকতার অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। স্বার্থের সংঘাত, বস্তুগত সম্পদের প্রতি গভীর আগ্রহ এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাব আমাদের পরিবেশের অবনমনকে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় রূপান্তরিত করেছে। আমরা ইতিমধ্যে পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট আগ্রহী হলেও সেইসব ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা উপস্থিত হয়েছে-যাকে উত্তীর্ণ হতে না পারলে পরিবেশের সুরক্ষা অর্থহীন হয়ে পড়বে।

পরিবেশ রক্ষা কী

পরিবেশের অবনমন থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা এবং পরিবেশের সম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত করার প্রক্রিয়া হল পরিবেশ রক্ষা। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে পরিবেশের সমস্যা যেভাবে সম্পৃক্ত হয়ে উঠছে, সেখানে পরিবেশকে রক্ষা করা কিম্বা পরিবেশের অবনমন থেকে সুরক্ষা দেওয়া সমস্যা হয়ে উঠেছে। অতীতকালে উত্তর ভারতের কোনো গ্রামে সেখানকার রাজা কাঠ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গ্রামের চারপাশের গাছগুলি কাটবার জন্য লোকলস্কর পাঠিয়েছিলেন। যেহেতু এই গাছগুলি গ্রামবাসীদের কাছে খুব প্রিয় তাই গ্রামের মহিলারা দু-হাত ধরে গাছগুলিকে জড়িয়ে ধরলেন। ফলে রাজার লোকলস্কর ফিরে গেল। এটিও পরিবেশ রক্ষার একটি উপায়। এই ঘটনাকে ঘিরে উত্তরপ্রদেশে চিপকো আন্দোলন গড়ে ওঠে।

পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব

ক্রমবর্ধমান জনবিস্ফোরণের চাপে পরিবেশের ভারসাম্য আজ বিঘ্নিত। উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য, কুসংস্কারে বিশ্বাস, অপরিণামদর্শিতা, প্রশাসনিক গাফিলতি এবং সর্বোপরি মানুষের সচেতনতার অভাব-আজ পরিবেশের সমস্যাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অপরিমিত ভোগাকাঙ্ক্ষা এবং তার জন্য নগরায়ন, শুধু কৃষির উপর ভরসা না করে মানুষের জীবনধারণের মান ও আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন প্রভৃতি পরিবেশের সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলায় পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব যথেষ্ট বেড়েছে।

সমস্যার স্বরূপ

১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের রিও-ডি-জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বসুন্ধরা সম্মেলনের প্রধান অংশীদার ছিল ভারত। এরপর থেকেই পরিবেশ রক্ষায় ভারত পরিবেশের প্রতি সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ধনী দেশগুলি খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। অথচ তারাই সি. এফ. সি. উৎপাদন করছে বেশি। এই নিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বিতর্কও দানা বেঁধেছে। উত্তর (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি) ও দক্ষিণ (মূলত এশিয়ার উন্নতশীল দেশ, আফ্রিকা প্রভৃতি) বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু সি. এফ. সি. বনাম জনসংখ্যা ও অশিক্ষা। তাই পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে পৃথিবীব সব দেশ সমান আগ্রহী নয়। এমনকি আমেরিকা বসুন্ধরা সম্মেলনের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহীও নয়। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের দেশে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে অনেক। কিন্তু সেইসব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মুনাফা অর্জন করছে, পরিবেশের ক্ষতি করে। অর্থাৎ আমাদের এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ করে আইনকে ফাঁকি দেখিয়ে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত, আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তজ্জনিত ক্রমবর্ধমান পরিবেশের অবনমন, পরিবেশ রক্ষার অন্যতম সমস্যা। চতুর্থত, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যেভাবে বাধ্য হয়ে রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, তাকে বন্ধ করার প্রক্রিয়াগুলি আমাদের দেশে কার্যকর করা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঞ্চমত, নগরায়ন ও শিল্প বিকাশ অনিয়মিত এবং অনেকক্ষেত্রে বে-আইনি হওয়ায় পরিবেশের রক্ষা সমস্যা হয়ে উঠেছে। শিল্প সংস্থাগুলি আই. এস. ও. ১৪০০০ বিধি গ্রহণের ও তাকে মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আগ্রহী না হওয়ায় পরিবেশের সুরক্ষা সমস্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ষষ্ঠত, প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন ও সরকারি ভূমিকা আমাদের দেশে এত বেশি নগণ্য যে, যে কোনো সমস্যা থেকে উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ সমস্যাকে সমাধানের পথে নিয়ে যেতে গেলে নতুন নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। পরিবেশকে সুরক্ষার জন্য সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে-শুধু ভোট ব্যাংকের কথা ভাবলে হবে না। সপ্তমত, যে কোনো সমস্যা বাড়ে সচেতনতার অভাবের জন্য। এই অসচেতনতার কারণ অশিক্ষা-যা আমাদের দেশে এখনো বড়ো সমস্যা। সেজন্য পলিথিনের ব্যবহার, নির্বিচারে গাছ কাটা, বন কাটা, অবৈজ্ঞানিক জীবনযাপনের চেষ্টা প্রভৃতিকে বন্ধ করা যাচ্ছে না। অষ্টমত, অতিরিক্ত ভোগবাদ ও বস্তুসর্বস্বতা পরিবেশের সাধ্যায়ত্ত উন্নয়নের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে, পরিবেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করেছে।

প্রতিকার

এই সমস্যাকে সমাধানের পথ দেখাতে হলে চাই সংশ্লিষ্ট সকলের ইতিবাচক মনোভাব এবং সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ। সেই সঙ্গে চাই জনসংখ্যার স্থিতাবস্থা, সমন্বিত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, সমৃদ্ধ শস্যক্ষেত্র ও তৃণভূমি, বহু ফসলী কৃষিজমিকে শিল্পভূমিতে রূপান্তরিত না করা, ভূমি ও প্রান্তিক ভূমির সবুজায়ন, জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জল, বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, অচিরাচরিত শক্তির উৎসকে বেশি করে কাজে লাগানো, পরিবেশ অনুকূল জনবসতি ও বস্তি উন্নয়ন, সকলের জন্য পরিবেশ শিক্ষা ও সচেতনতা, পরিবেশ আইনসমূহের সংশোধন ও নবীকরণ এবং জাতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার নতুন মাত্রা সংযোগ প্রভৃতি।

উপসংহার

পরিবেশ রক্ষার সমস্যাকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে ভাবতে হবে, ভাবতে হবে সকলকে একযোগে। এই সমস্যা যেহেতু সকলের দ্বারা সৃষ্ট তাই ভাবতে হবে সকলকেই। বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত করে রাখতে হলে চাই সদর্থক পদক্ষেপ ও সার্বিক সচেতনতা।

Leave a Comment