পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকার বর্ণনা দাও

পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকার বর্ণনা দাও
পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকার বর্ণনা দাও।
ভূপৃষ্ঠের ওপর অবস্থিত যে আলগা আবরণ গাছপালা জন্মাতে এবং চাষ-আবাদ করতে সাহায্য করে, তাকে মৃত্তিকা বলে। মৃত্তিকা সাধারণত শিলাচূর্ণ এবং জৈব পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। তাই মৃত্তিকার উৎপত্তি শিলার প্রকৃতি এবং জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে শিলার প্রকৃতি এবং জলবায়ু ভিন্ন ভিন্ন বলে এখানে বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকা দেখা যায়। প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, উপাদান ও উৎপত্তির পার্থক্যের জন্যে পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা– পলি মৃত্তিকা, ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা, পডসল মৃত্তিকা, ধূসর বাদামি রঙের মৃত্তিকা এবং উপকূলের লবণাক্ত মৃত্তিকা।

পলি মৃত্তিকা

(i) অবস্থান: পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলের নদী তীরবর্তী প্লাবনভূমিতে পলিমাটি দেখা যায়।

(ii) উৎপত্তির কারণ: নদীবাহিত পলি, বালি, কাদা ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে পলি মৃত্তিকার উদ্ভব হয়।

(iii) বিশেষত্ব:

  • (A) প্রকৃতি: এই মাটি খুবই উর্বর প্রকৃতির হয় ও অধিক গভীরতাযুক্ত হয়।
  • (B) বর্ণ: উত্তরের সমভূমির প্রাচীন পলিমাটি হালকা লাল রং-এর এবং দক্ষিণের সমভূমির নবীন পলিমাটি কালচে বাদামি রঙের হয়ে থাকে।
  • (C) উপাদান: বালি ও কাদার উপাদান অনুসারে পলি মাটিকে তিনটি উপবিভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। (a) বেলে মাটি, (b) দোআঁশ মাটি ও (c) এঁটেল মাটি। যে মাটিতে বালির ভাগ বেশি, তাকে বেলে মাটি, যে মাটিতে বালি ও কাদার ভাগ সমান সমান, তাকে দোআঁশ মাটি এবং যে মাটিতে কাদার ভাগ বেশি, তাকে এঁটেল মাটি বলে।
  • (D) উদ্ভিদ: আম, জাম, বট, অশ্বত্থ, কাঁঠাল, ডুমুর, সুপারি, তাল, কলা প্রভৃতি গাছ জন্মায়।
  • (E) উৎপাদিত ফসল: বেলে মাটিতে তরমুজ, ফুটি, শশা ইত্যাদি; দোআঁশ মাটিতে গম, ইক্ষু, তামাক ও নানারকমের সবজি এবং এঁটেল মাটিতে ধান ও পাট ভালো জন্মায়।

ল্যাটেরহিট মৃত্তিকা

(i) অবস্থান : মূলত পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান ও ঝাড়গ্রাম জেলায় এই মাটি দেখা যায়।

(ii) উৎপত্তির কারণ: অপেক্ষাকৃত বড়ো বড়ো নুড়ি, কাঁকর ইত্যাদি জমে এই মাটি তৈরি হয়েছে।

(iii) বিশেষত্ব:

  • (A) প্রকৃতি: এই মাটির সচ্ছিদ্রতা বেশি ও জলধারণ ক্ষমতা কম। এটি কাঁকরপূর্ণ মাটি।
  • (B) বর্ণ: ‘ল্যাটার’ শব্দ থেকে ‘ল্যাটেরাইট’ কথাটি এসেছে। এর অর্থ ‘ইট’। এই মাটি ইটের মতো লাল বর্ণের।
  • (C) উপাদান: এই মাটিতে লোহার পরিমাণ বেশি থাকে।
  • (D) উদ্ভিদ: কুল, পলাশ, মহুয়া ইত্যাদি পর্ণমোচী উদ্ভিদ।
  • (E) উৎপাদিত ফসল: এই মাটিতে জলসেচের মাধ্যমে ধান, ভুট্টা, আখ ও বিভিন্ন শাকসবজি উৎপন্ন হয়।

পডসল মৃত্তিকা

(i) অবস্থান: মূলত দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলার পার্বত্য অঞ্চলে দেখা যায়।

(ii) উৎপত্তির কারণ: পার্বত্য অরণ্যের গাছ থেকে পড়া পাতা, ডাল ইত্যাদি পচে মাটির সঙ্গে মিশে এই মৃত্তিকা সৃষ্টি করে।

(iii) বিশেষত্ব:

  • (A) প্রকৃতি: এই মাটি নুড়ি, পাথরে পূর্ণ ও আম্লিক প্রকৃতির।
  • (B) বর্ণ: ‘পডজল’ কথাটির অর্থ ‘ছাই রঙের মৃত্তিকা’। এর বর্ণ কালো, বাদামি বা ধূসর হয়।
  • (C) উপাদান: এই মাটি জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ।
  • (D) উদ্ভিদ: পাইন, ফার ইত্যাদি পার্বত্য উদ্ভিদ জন্মায়।
  • (E) উৎপাদিত ফসল: চা, সিঙ্কোনা, কমলালেবু, আপেল।

ধূসর বাদামি রাঙর মৃত্তিকা

(i) অবস্থান: হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশীয় দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার সমতল অংশে দেখা যায়। 

(ii) উৎপত্তির কারণ: তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা প্রভৃতি নদী দ্বারা বাহিত নুড়ি, কাঁকর, পলি, বালি জমে তৈরি হয়েছে।

(iii) বিশেষত্ব:

  • (B) প্রকৃতি: সচ্ছিদ্র, আম্লিক এবং আর্দ্র প্রকৃতির।
  • (C) বর্ণ: এটি গাঢ় ধূসর বা কৃষ্ণবর্ণের হয়।
  • (D) উপাদান: হিউমাস, কাঁকর, পলি, বালি।
  • (E) অরণ্যসম্পদ : শাল, সেগুন, গামার, শিরীষ, জারুল, শিশু, বাঁশ, বেত প্রভৃতি গাছ জন্মায়।
  • (F) উৎপাদিত ফসল : ধান, চা, গম, যব, জোয়ার, বাজরা, আলু, কমলালেবু।

উপকূলের লবণাক্ত  মৃত্তিকা

(i) অবস্থান: পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে দেখা যায়।

(ii) উৎপত্তির কারণ: নদীবাহিত পলির সঙ্গে সমুদ্রতরঙ্গবাহিত পলি যুক্ত হয়ে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।

(iii) বিশেষত্ব:

  • (A) প্রকৃতি: লবণাক্ত ও ক্ষারধর্মী।
  • (B) বর্ণ: এটি কালো রঙের হয়ে থাকে।
  • (C) উপাদান: বালি, পলি ও অতিরিক্ত লবণ।
  • (D) উদ্ভিদ: সুন্দরী, গরান, গেওয়া, হোগলা, নারকেল ইত্যাদি।
  • (E) উৎপাদিত ফসল: তরমুজ, লঙ্কা, সূর্যমুখী, সুপুরি ও সামান্য কার্পাস।

Leave a Comment