পুঁইমাচা গল্পের উৎস, প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু একাদশ শ্রেণি ১ম সেমিস্টার বাংলা

পুঁইমাচা গল্পের উৎস, প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু একাদশ শ্রেণি ১ম সেমিস্টার বাংলা
পুঁইমাচা গল্পের উৎস, প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু একাদশ শ্রেণি ১ম সেমিস্টার বাংলা

উৎস

আমাদের আলোচ্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পটি তাঁর লেখা ‘মেঘমল্লার’ গল্পগ্রন্থ থেকে গৃহীত। গল্পটি ১৩৩১-এর মাঘ সংখ্যায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল।

প্রেক্ষাপট

‘পুঁই মাচা’ গল্পটি রচিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কুফলকে আশ্রয় করে। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সতীদাহপ্রথা রদ হয়। ১৮৫৬-তে বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বিধবাবিবাহ আইন চালু হয়। সেই সঙ্গে বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বিদ্যাসাগর। সতীদাহের প্রায় ১০০ বছর পর এবং বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ আন্দোলনের ৭৫ বছর পর ১৯২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন ‘পুঁই মাচা’ গল্পটি। গল্পটি সম্পর্কে বলা যায়-

১। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্ষেন্তি। ক্ষেন্তির মৃত্যুর কারণ- বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লালিত পণপ্রথা।

২। গল্পটি বুর্জোয়াতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্রের নোম্যানসল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে।

৩। ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিষবৃক্ষটি স্পষ্টহয়ে উঠেছে গল্পে।

৪ । ক্ষেন্তি মারা যাওয়ার পর আরও দীর্ঘ আট মাসের বর্ণনা গল্পে আছে।

অর্থাৎ ট্র্যাজেডিই জীবনের চূড়ান্ত সীমারেখা- এটা বিভূতিভূষণের সাহিত্য দর্শনের ক্ষেত্র নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন- “বেদনানুভূতি আসলে আত্মানুভূতি ছাড়া আর কিছু নয়। দুঃখের সংবেদন আত্মবেদনকেই গভীর করে তোলে। আর আত্মসংবেদন যত গভীর হয় ততটা নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জীবনের স্বর্গীয় গতি।” ‘পুঁই মাচা’ জীবনের সেই আত্মজীবনকে চিনিয়ে দেয়।

বিষয়-সংক্ষেপ

ভূমিকা: কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পে একটি সাধারণ গ্রাম্য দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের করুণ আলেখ্য ফুটিয়ে তুলেছেন।

সহায়হরি চাটুজ্যে সৎ ও সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। অর্থাভাবে সে তার দুই মেয়েকে ভালোভাবে খেতে দিতে পারেন না। লোকের কাছে চেয়েচিন্তে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন কিছু। তবে তার স্ত্রী অন্নপূর্ণার এটা পছন্দ নয়। তাই তিনি স্বামীকে পদে পদে তিরস্কার করেন। কিন্তু সহায়হরি তথৈবচ, আর উপায়ই -বা কী? তার বড়ো মেয়ে ক্ষেন্তি যে বড়ো হয়ে উঠছে, এ কথা সহায়হরি মনে আনতে চান না। কিন্তু অন্নপূর্ণা এই ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। তিনি সর্বদা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বামীকে তাগাদা দিতে থাকেন। তিনি বাস্তববাদী। কারণ নাহলে গ্রামে একঘরে হয়ে যেতে হবে। ক্ষেন্তির একবার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েও ভেঙে গিয়েছিল। এখন তার বয়স পনেরো।

ক্ষেন্তির মধ্যেও পরিণতি আসেনি। সমাজ-সংসার যে কতটা রুক্ষ সে জানে না, বোঝে না। রায়দের ফেলে দেওয়া পুঁইশাকের ডাঁটা সে নিয়ে আসে। খেতে বড়ো ভালোবাসে সে। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে বকুনি খায়। অন্নপূর্ণা খুব বাস্তববাদী, আপাত কঠোর হলেও ভিতরটা তার বড্ড নরম। মেয়েদের প্রতি তার স্নেহের একটুও অভাব নেই। নিজেরই ফেলে দেওয়া পুঁইডাঁটা তিনি কুড়িয়ে এনে রেঁধে দেন। পিঠের সময় নারকোল কোড়া দিয়ে পাটিসাপটা করে দেন। ক্ষেন্তি একটু বেশি খেলে তার কোনো বিরক্তি নেই, বরং এতে আনন্দে মনের কুল ছাপিয়ে যায়। ইতোমধ্যে ক্ষেন্তির বিয়ের ঠিক হয়। পাত্র বয়সে অনেক বড়ো। কিন্তু তাদের মতো দরিদ্রের বাছবিচার করলে চলে না। পণের টাকা সব দিয়েও সহায়হরির ১৫-২০ টাকা মতো বাকি রয়ে গেল। ওই জন্য মেয়েকে তারা আর বাপের বাড়িতে আসতে দেয় না। এদিকে ক্ষেন্তির হাতে পোঁতা একটা পুঁইচারা ক্রমশ বাড়তে থাকে, মাচা ভরতি হয়ে যেতে থাকে সবুজে।

বছর ঘুরে গেল। আবার চলে এল পিঠেপার্বণ। ক্ষেন্তির বোন পুঁটির পিঠে খাওয়ার সময় দিদির কথা মনে পড়ে। আর একজনেরও তার কথা মনে পড়ল, তিনি ক্ষেন্তির জন্মদাত্রী কিন্তু তাকে তো প্রকাশ করতে নেই অন্তরের শূন্যতা! ক্রমে পুঁইমাচাটা যেন ভরে উঠেছে তাদের উঠান জুড়ে, তাদের হৃদয় জুড়ে, স্মৃতির স্তবক জুড়ে।

Leave a Comment