![]() |
প্রতিযোগিতা নয় সহযোগিতা রচনা |
ভূমিকা
একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে বাজার অর্থনীতির রমরমা, বিদেশি পুঁজির আগমন যেখানে উন্নতির ভিত্তি, আর বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগে শিক্ষিত বেকারদের স্বপ্নের মিনার যেখানে নির্মিত হচ্ছে এবং সেই স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র যেখানে ‘এক দেশ, এক কর, এক বাজার’ নীতি চালু করে দিয়েছে সেখানে প্রতিযোগিতা নামক বিষয়টি যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে, তা বলা বাহুল্য। শুরু হয়েছিল ‘সমগ্র বিশ্ব একটি বাজার’-এই তত্ত্বকে সামনে নিয়ে আর শেষ হল ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ও ‘জিএসটি’ দিয়ে। এগুলির মোদ্দা কথা হল বাজার অর্থনীতি ও প্রতিযোগিতা। আর প্রতিযোগিতা সহযোগিতার পরিপন্থী। তাই ভারতীয় জীবনচর্যায় যেখানে ছিল সহযোগিতা, তার স্থানে এল প্রতিযোগিতা, এল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রতিযোগিতা
সুফল
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিযোগিতার বাজারে লড়াইর মনোভাব থাকে বলেই বাজারে নিজের অস্তিত্ব ও যোগ্যতা প্রমাণিত হয়। যোগ্যতা প্রমাণের জন্য যাচাইর ক্ষেত্র হল প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার। তাই প্রতিযোগিতার সুযোগ আছে বলেই অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। আবার সামাজিক ক্ষেত্রে সংস্কার দূরীভূত হয়, সমাজজীবনে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ফিরে আসতে পারে। সমাজের একটি ভাল দিকের প্রতিফলন ঘটলে, তা দেখে অন্যরাও তাতে আকৃষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের কল্যাণকর প্রতিযোগিতা সমাজে থাকা বাঞ্ছনীয় এবং তার দ্বারা অনেক সুফলও পাওয়া যায়। সেজন্য শিল্পপতিদের প্রতিযোগিতায় শিল্প সম্ভাবনা বাড়ে, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভর্তি হতে পারে। চাকরির ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রমাণ করে চাকরিলাভের সুযোগ আসে। সর্বোপরি সমাজে ও অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা রয়েছে বলেই সমাজের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
সংকট
বিশ্বায়নের ফলে আজকের একবিংশ শতাব্দীর মানুষ বাজার অর্থনীতির অক্টোপাশে আবদ্ধ হয়ে বড়ো বেশি কৃত্রিম ও স্বার্থসর্বস্ব জীবনকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হয়েছে। বাজারসর্বস্ব অর্থনীতির ঠেলায় প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে মানুষ তার চিরন্তন চারিত্রিক সম্পদগুলিকে (ত্যাগ, ধৈর্যশক্তি, মায়া-মমতা-ভালোবাসা, শ্রমশীলতা) হারিয়ে ফেলেছে বা অবক্ষয়িত করেছে। আজ ভারতে একটি শিশু জন্ম নেবার পর থেকেই সে জানছে প্রতিবেশী দেশ তার শত্রু। আবার উচ্চাশার রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ইঁদুরদৌড়ে সামিল করে দিচ্ছেন। নির্মম অসম প্রতিযোগিতায় নেমে শিশুমন দিশেহারা হয়ে পড়ছে। বর্তমান কর্পোরেট জীবনে বিজয়ীর প্রতিষ্ঠা আর বিজিতের অপমৃত্যু। সেকেন্ড হওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, যত কৃতিত্ব ফার্স্ট হওয়ার মধ্যে। প্রতিযোগিতায় হেরে মানুষ যেমন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তেমনই চেয়ার টেবিল ভেঙে, মানুষকে আহত করে তারা আনন্দ প্রকাশ করে। বিষম প্রতিযোগিতায় মানুষ দিশেহারা হয়ে উন্মত্ত খ্যাপা কুকুরের মতো লোভ, লালসার, ভোগের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় ও শঙ্করের কথা, যারা লোভের বশবর্তী হয়ে কীভাবে ছুটে চলেছিল।
সহযোগিতার গুরুত্ব
অথচ মানুষ একদিন যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে পরস্পর সহযোগিতার সূত্রে সমাজ গড়েছিল। বন্য পশুদের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য ও নিজেদের সভ্য হিসেবে প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষ পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ত্যাগ প্রভৃতি শব্দগুলিকে ত্যাগ করতে করতে বাজার অর্থনীতির মার্কেটে সেগুলিকে বেচে উচ্ছ্বসিত হতে থাকল। হবেই না বা কেন? দিয়ো আত্মতৃপ্তিতে জীবনে ত্যাগের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় সহযোগিতার ব্যাপারটাকে সামাজিক ক্ষেত্রে আই. সি. ইউ-তে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কেননা ত্যাগে তো আর আনন্দ নেই, ভোগে যত আনন্দ। আর সহাবস্থান-এর মনোভাব যদি না থাকে তাহলে সহযোগিতার ভাব আসবে কী করে? বাজার অর্থনীতির এই প্রতিযোগিতা মানুষের শান্তি, সহজ, সুন্দর জীবনের ভাবনাকে কেড়ে নিয়ে সহযোগিতার ভাবকে মানুষের মন থেকে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিল। তা না হলে বৃদ্ধ বাবা মাকে কেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হয়, দাম্পত্যজীবনে কেন এত ডিভোর্সের ছড়াছড়ি, কেনই বা পিতা-পুত্রের সম্পর্কে এত ফাটল? এর কারণ ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। অথচ পারস্পরিক সহযোগিতা থাকলে সামাজিক এই অবনমনগুলি প্রতিরোধ করা যেতে পারতো। তাই বলে প্রতিযোগিতার বিরোধিতা নয়, বরং সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা। তার মানে তুমি প্রতিযোগিতার শীর্ষে উঠে আরাম করো, কিন্তু আমি প্রতিযোগিতার নিম্নে আছি বলে তুমি আমার আরামের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে-তাতে আর যাই হোক, মনুষ্যত্বের অবমাননাই হয়।
উপসংহার
আজকের ভারত বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় পাশ্চাত্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, সাফল্যকে শীর্ষস্তরে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু হারাতে হয়েছে ভারতীয় জীবনচর্যার সূক্ষ্ম প্রবৃত্তিগুলিকে। সেই সূক্ষ্ম চিত্তবৃত্তিগুলিকে ফিরিয়ে আনতে, সহযোগিতা ও সহাবস্থানকে গুরুত্ব দিতে ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘যোগদিবস’ প্রভৃতির পরিকল্পনা। কিন্তু মানুষের মনে যে অস্বচ্ছতা বাসা বেঁধেছে, অপরিমিত ভোগাকাঙ্ক্ষা যেখানে মানুষকে গ্রাস করেছে সেখানে সহযোগিতা তথা ত্যাগের মানসিকতা না থাকলে ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘যোগদিবস’ প্রভৃতির কর্মসূচির যথাযথ রূপায়ণ কী সম্ভব? তাই ভবিষ্যৎই বলতে পারবে ‘প্রতিযোগিতা নয় সহযোগিতা’ এই বার্তা কতদূর তথাকথিত এই সভ্য মানুষদের আকৃষ্ট করতে পারবে।