প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৮৭১ থেকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে অনেকে ‘সশস্ত্র শান্তির যুগ’ (Age of Armed peace) বলে অভিহিত করেছেন। এ সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি উত্তেজক থাকলেও, হঠাৎ করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা কেউ কল্পনা করতে পারে নি। এই কালপর্বে ইউরোপে নানা শক্তির মধ্যে নানা ধরনের সংঘাত চলছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের প্রশ্ন ছিল। ইউরোপের সব জাতিই তখন নিজেদের জাতি-গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয় ওঠে। এই উৎকট জাতীয়তাবাদী মনোভাব যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করে। এ সময় ইউরোপে শুরু হয় বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। নিজেদের দেশের উদ্বৃত্ত মালপত্র বিক্রি এবং এজন্য বর্হি-ইউরোপীয় দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার প্রভৃতি প্রশ্নে ইউরোপে এক উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক বিদ্বেষ ও সন্দেহ থেকে শুরু হয় আত্মরক্ষার জন্য সমর সজ্জা ও সামরিক প্রতিযোগিতা। প্রায় সব শক্তিই সামরিক বাহিনী, যুদ্ধজাহাজ, নৌ-সেনা প্রভৃতির সংখ্যা বৃদ্ধি করে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। 
  • জার্মান সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম বিশ্বরাজনীতিতে জার্মানির সক্রিয় অংশগ্রহণ ও হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নৌশক্তি বৃদ্ধি, উপনিবেশ দখল প্রভৃতির মাধ্যমে জার্মানির শক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। কাইজারের এই সক্রিয় নীতি ওয়েল্ট পলিটিক নামে পরিচিত। তিনি বিশ্বজয়ের জন্য বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করলে ফ্রান্স আতঙ্কিত হয় এবং মনে করে যে, জার্মানির শক্তি বৃদ্ধি পেলে আলসাস-লোরেন পুনরুদ্ধার হবে না। এর ফলে ফ্রান্স সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে জার্মানিও পুনরায় তার সেনাদল বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়। এর ফলে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে এক অন্তহীন সামরিক প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। 
  • ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা শুরু হয়। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে জার্মানি। ফ্রান্স ও রাশিয়াতেও অনুরূপ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এর ফলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। 
  • ১৮৯৭, ১৮৯৮ এবং ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি নতুন নৌ-নির্মাণ নীতি গ্রহণ করে বড়ো ও মাঝারি পাল্লার যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন নির্মাণ শুরু করলে ইংল্যান্ড আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং ১৯০৩ সাল থেকে ইংল্যান্ড জার্মানির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে উত্তর সাগরীয় নৌবহর নামে নতুন একটি নৌবহর নির্মাণ শুরু করে। আবার ইঙ্গ-ফরাসি আঁতাত কর্ডিয়েল (১৯০৪ খ্রিঃ) দ্বারা ভূমধ্যসাগরে পাহারাদারির দায়িত্ব ফরাসি নৌবাহিনীকে দিয়ে, ব্রিটেন উত্তর সাগর (North Sea) ও ইংলিশ চ্যানেলে তার নৌশক্তিকে সংহত করতে থাকে। বলা বাহুল্য, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। 
  • বলকান অঞ্চলের অস্ট্রিয়া-রাশিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দুই রাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতি বৃদ্ধি পায়। এইভাবে অস্ত্র উৎপাদন, সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি, সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রভৃতির মাধ্যমে সমগ্র ইউরোপ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

Leave a Comment