প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করো

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করো
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করো।

ভূমিকা

ভৌগোলিক ব্যাপ্তির নিরিখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি) ছিল ব্যাপক, ভয়াবহ ও সর্বাত্মক। তাই এই যুদ্ধ সামরিক ও অসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। প্রখ্যাত লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক তাঁর লিখিত ‘অল কোয়াইট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ উপন্যাসে যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব তুলে ধরেছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের  ফলাফল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলগুলির দিকগুলি হল- মধ্যে উল্লেখযোগ্য

[১] জীবনহানি ও সামাজিক পরিবর্তন : চার বছরব্যাপী সর্বনাশা যুদ্ধে দশ মিলিয়ন মানুষের জীবনহানি হয় এবং কুড়ি মিলিয়ন মানুষ আহত হয়েছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় সাড়ে ছয় কোটি সেনার মধ্যে এক কোটিরও বেশি সেনা মারা যায়। পঙ্গু হয়ে যায় বহু মানুষ। খাদ্যাভাব, রোগ ও মহামারিতে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। ফলে নারীর প্রাধান্য তথা নারীমুক্তি আন্দোলন ত্বরান্বিত হয় এবং নারী শ্রমিকসহ শ্রমিক শ্রেণি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়ে ওঠে।

[২] বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামরিক ব্যয় হয়েছিল ১৮০ বিলিয়ন ডলার, আর পরোক্ষ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১৫০ বিলিয়ন। বিশ্ব-অর্থনীতি কোনো না কোনো ভাবে এই যুদ্ধের ফলে বিধ্বস্ত হয়েছিল। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে যুদ্ধজনিত কারণেই প্রায় দেড়শো বিলিয়ন • ডলার মূল্যের সম্পত্তি নষ্ট হয়। কলকারখানা ধ্বংস হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হয়, অন্যদিকে তীব্র বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয়, জনগণের আর্থিক দুর্দশাও বৃদ্ধি পায়।

[৩] রাজনৈতিক কাঠামোয় বিপর্যয়: ইউরোপীয় রাজনীতির আঙ্গিকেও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। ইউরোপের দুটি বিবদমান শক্তিজোট এই যুদ্ধে অংশ নেয়-একদিকে ব্রিটেনের নেতৃত্বে ত্রিশক্তি-মৈত্রী, অন্যদিকে জার্মানির নেতৃত্বে ত্রিশক্তি চুক্তি। এই দুই শিবিরে রাজনৈতিক কাঠামো কম-বেশি বিধ্বস্ত হয়েছিল।

[৪] বলশেভিক বিপ্লব: যুদ্ধকালীন সময় বলশেভিক বিপ্লবের (১৯১৭ খ্রি.) ধাক্কায় রাশিয়ায় রোমানভ রাজবংশ ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং সদ্য-প্রতিষ্ঠিত বলশেভিক সরকার যুদ্ধ থেকে সরে এসে শত্রুপক্ষ জার্মানির সঙ্গে সন্ধি করে এবং এর ফলে ইউক্রেন, ক্রিমিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চল রাশিয়ার হস্তচ্যুত হয়।

[৫] জার্মানির উপর ক্ষতিপূরণের বোঝা: তাৎক্ষণিক দিক থেকে জার্মানি লাভবান হলেও শেষপর্যন্ত জার্মানি নিজেই পরাজিত হয় এবং মধ্য-ইউরোপ ও পূর্ব-ইউরোপে রাজনৈতিক কাঠামো বিনষ্ট হয়। জার্মানির উপর যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয় তাতে জার্মান অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।

[৬] পূর্বতন বৃহৎ রাজতন্ত্রের অবসান: জার্মানিতে হোহেনজোলার্ন রাজতন্ত্র, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিতে হ্যাপসবার্গ রাজতন্ত্র, তুরস্কে অটোমান রাজতন্ত্র ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই অবস্থায় মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে রাজনৈতিক শূন্যতা ও অস্থিরতা দেখা দেয়।

[৭] গণতন্ত্রে জাতীয়তাবাদের জয়: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটিয়েছিল এবং চিন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গতি এনেছিল। যুদ্ধশেষে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনেও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬টি-তে।

Leave a Comment