প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে কী জান
অথবা, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি ব্যাখ্যা করো

ভূমিকা
প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেন প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। এথেন্সের এক অভিজাত পরিবারে প্লেটো জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য। প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থটি হল ‘রিপাবলিক’ (Republic)। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা তুলে ধরেছেন।
(1) প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্বের বিভিন্ন দিক
(1) রাষ্ট্রের জৈবিক সত্তা: প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তায় দর্শনের প্রভাব লক্ষণীয়। তাঁর মতে, জীবদেহের ন্যায় রাষ্ট্রেরও নিজস্ব প্রাণ ও ব্যক্তিত্ব আছে। তাঁর মতে, ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ন্যায় রাষ্ট্রও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে।
(2) আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা: প্লেটো বলেছেন মানুষ মূলত অর্থনৈতিক প্রয়োজনের তাগিদেই প্রথম রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে যে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছেন, তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- শ্রেণিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে নাগরিকদের মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা- (a) শাসকশ্রেণি, (b) যোদ্ধা শ্রেণি এবং (c) উৎপাদক বা কারিগর শ্রেণি। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে উদ্ভব ঘটে শাসকশ্রেণির। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা এবং নতুন রাজ্যজয়ের প্রয়োজনে উদ্ভব ঘটে যোদ্ধা শ্রেণির। আর রাষ্ট্রের উৎপাদনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে যে শ্রেণি, তারাই হল কারিগর শ্রেণি। প্লেটো তাঁর রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনায় তৃতীয় শ্রেণিকে তেমন মর্যাদা বা গুরত্ব দেননি।
- ন্যায়বিচার: প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করেছেন তার মূলভিত্তি হল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। প্লেটোর মতে, “ন্যায়বিচারই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি বা প্রাণস্বরূপ” (Justice is the life breath of the state)। তাঁর মতে, একমাত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের সুন্দর জীবন বজায় রাখা সম্ভব।
- স্বাভাবিক রাষ্ট্রের ধারণা: প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্র কল্প-রাষ্ট্র হতে পারে না। আদর্শ রাষ্ট্র হল স্বাভাবিক রাষ্ট্র। তাঁর মতে, আদর্শ বা স্বাভাবিক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নাগরিকদের শুভচিন্তার দ্বারা সুশিক্ষিত করে তোলা।
- ব্যক্তির ভূমিকা: প্লেটো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রেরই অংশ বলে মনে করলেও ব্যক্তির স্বতন্ত্র অধিকারকে কোনো গুরুত্ব দেননি। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের যৌথ স্বার্থের বাইরে ব্যক্তিস্বার্থের কোনো মূল্য নেই।
- সরকারের শ্রেণিবিভাগ: প্লেটো রাষ্ট্র বা সরকারকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং সংশোধিত গণতন্ত্র। গুরু সক্রেটিসের হত্যা তাঁর মনে গণতন্ত্রের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার করে। তাই তিনি রিপাবলিক বা গণরাজ্যের কল্পনা করেছিলেন।
মূল্যায়ন
প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন বিশ্লেষণ করে অনেকেই একে কল্পনাবিলাস (Utopia) বলে সমালোচনা করেছেন। আবার অনেকে বলেছেন, তাঁর রাষ্ট্রদর্শন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিরোধী। তথাপি প্রাচীন কাল থেকে যুগ যুগ ধরে যে রাষ্ট্রচিন্তার ধারণা গড়ে উঠেছে, তার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন প্লেটো।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর