![]() |
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো
|
সূচনা
গ্রাহাম শ ১৭৭০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে ৪০টি ছাপাখানার কথা উল্লেখ করেছেন। এর অধিকাংশই সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই সংবাদপত্রগুলির অধিকাংশই ছিল সাপ্তাহিক। বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে ছিল ‘দি ইন্ডিয়া গেজেট’ (সোমবার), হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ (শনিবার), ‘দি ক্যালকাটা ক্রনিক্যাল’ (মঙ্গলবার), ‘দি ক্যালকাটা গেজেট’ (বৃহস্পতিবার), ‘দি এশিয়াটিক মিরর’ (বুধবার) এবং ‘দি রেকর্ডার’ (রবিবার)। এছাড়াও এই ছাপাখানাগুলি থেকে ছাপা হত আদালত ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলির নানা বিজ্ঞপ্তি ও ইস্তেহার, হিন্দু-খ্রিস্টান-মুসলিম পঞ্জিকা ও ক্যালেন্ডার, কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের নাম-ধাম-ঠিকানা সম্বলিত পুস্তিকা, কলকাতার মানচিত্র, দেশীয় ভাষা শিক্ষার জন্য অভিধান এবং চিকিৎসা ও আইন সম্বন্ধিত কিছু পুস্তিকা। এ সবই প্রকাশিত হত ইংরেজি ভাষায় এবং তার ক্রেতাও ছিল ইউরোপীয়রা।
বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তিনটি বইয়ের নাম পাওয়া যায় এবং সে বইগুলি প্রকাশিত হয়েছিল পোর্তুগালের রাজধানী লিসবন-এ। বইগুলি হল- (ক) কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ বা বেদ-লেখক ম্যানোয়েল-দা- আস্-সুম্প সাম। (খ) ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক সংবাদ-লেখক দোম অস্তিনিয় দো রোজারিও এবং (গ) বাংলা ব্যাকরণ ও পোর্তুগীজ- বাংলা শব্দকোষ-লেখক ম্যানোয়েল-দা-আস-সুম্প সাম।
ভারতে বাংলা অক্ষরে প্রথম মুদ্রিত বইটি হল ১৭৭৮ খিস্টাব্দে প্রকাশিত ন্যাথানিয়েলের ব্রাসি হালহেদ-এর লেখা বই-‘এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ বা হালহেদের ব্যাকরণ। বইটি ছাপা হয়েছে হুগলিতে মি. অ্যানড্রজের ছাপাখানায় কলকাতায় নয়। এটি ইংরেজি বই। কিন্তু এর পাতায় পাতায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, আর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল ও বিদ্যাসুন্দর থেকে উদ্ধৃতি। উদ্ধৃতিগুলি সবই বাংলা হরফে। সুতরাং ছাপার আয়নায় বাংলার বুকে এই প্রথম বাংলা হরফ দেখা গেল। বাংলা মুদ্রণে এতদিন কাঠের ব্লক ব্যবহৃত হত। কাঠের ওপর ছেনি দিয়ে কেটে কেটে পুরো লেখাটি সাজানো হত এবং তারপর তা ছাপা হত। হালহেদ-এর বইয়ে সর্বপ্রথম বিচল হরফ বা ‘মুভ এবল হরফ’ ব্যবহৃত হল। বাংলা মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে এ এক বিরাট অগ্রগতি।
বাংলা মুদ্রণের ব্যাপারে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-৮৫ খ্রি.) একটি স্মরণীয় নাম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যনুরাগী ব্যাক্তিমাত্রই হেস্টিংস-এর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তিনি দোষে-গুণে ভারত ইতিহাসের এক অদ্বিতীয় পুরুষ। হালহেদ-এর বইটি ছাপাবার ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কয়েক হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। এই বইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ এসেছিল বিলেত থেকে জাহাজে করে। তিনি হালহেদ-এর বইটি ছাপাবার দায়িত্ব দেন কোম্পানির সিভিলিয়ন এবং বিশিষ্ট বাংলা ও সংস্কৃত পণ্ডিত চার্লস উইলকিন্স-এর উপর। তাঁকে ‘বাংলা মুদ্রণশিল্পের জনক’ বলা হয়। তিনিই প্রথম ধাতু নির্মিত সঞ্চলনযোগ্য (moveable) বাংলা মুদ্রাক্ষরের জন্মদাতা। তিনি আগে থেকেই বাংলা হরফ তৈরির কাজে কিছুটা অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি পঞ্চানন কর্মকার ও জোসেফ শেফার্ড-এর সাহায্য নিয়ে নতুন বাংলা হরফ তৈরি করে হালহেদ-এর বইটির কাজ সম্পন্ন করেন। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, বাংলা মুদ্রণের স্মরণীয় শিল্পী পঞ্চানন ‘পঞ্চানন কর্মকার’ বলে পরিচিত হলেও তাঁর পদবি ছিল মল্লিক- পুরো নাম পঞ্চানন মল্লিক। তাঁর আদি নিবাস হুগলি জেলার জিরাট বলাগড় গ্রামে। বলাগড় থেকে বংশবাটি বা বাঁশবেড়ে এবং সেখান থেকে তিনি শ্রীরামপুরে চলে আসেন। অপুত্রক পঞ্চাননের এক কন্যা- জামাতা মনোহর পরবর্তীকালে মুদ্রাকর হিসেবে ইতিহাসে সুপরিচিত হন।
আঠারো শতকের সত্তরের দশক থেকে কলকাতায় যে-সব ছাপাখানা কাজ শুরু করেছিল তার পরিচালকরা ছিল ইংরেজ। বাঙালির জন্য বাংলা বই ছাপা শুরু হয় আরও কিছুদিন পরে। উনিশ শতকের সূচনা থেকেই বাংলা ছাপাখানার প্রসার ঘটতে থাকে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হল ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’ এবং শ্রীরামপুর ‘ব্যাপটিস্ট মিশন’। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেসে ছাপা হল বাইবেলের বঙ্গানুবাদ ‘মঙ্গল সমাচার মতীয়ের রচিত’। সেখানেই ছাপা হচ্ছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্য বইগুলি। ১৮০২ সালে গিলক্রিস্ট প্রতিষ্ঠা করলেন ‘হিন্দুস্থানী প্রেস‘। ১৮০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হল ম্যাথু ল্যাম্পসডেন-এর ‘পার্শিয়ান প্রেস‘। ১৮০৭-এ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত শিক্ষক বাবুরাম প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সংস্কৃত প্রেস’। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৮৪০-এ শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই কমপক্ষে ৫০টি ছাপাখানা ছিল। পুরো শতক জুড়ে সংখ্যাটা হাজারেরও বেশি। কলকাতার বিভিন্ন পাড়া তো বটেই, অলিতে-গলিতে তখন ছাপাখানা তৈরি হচ্ছে। শহর, গ্রামে-গল্পেও তার বিস্তার ঘটেছে। চব্বিশ পরগণার নৈহাটি, দমদম, বসিরহাট, চাঙরিপোতা, সোনারপুর ছাড়িয়ে বীরভূম, বাঁকুড়া মেদিনীপুর- এমনকী দার্জিলিং-ও তার প্রসার ঘটে। ১৮০০-তে হুগলির শ্রীরামপুরে মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হুগলি জেলা ছাপাখানা বিস্তারের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উত্তরপাড়া, বালি, বলাগড়, বাঁশবেড়িয়া, চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, তেলেনিপাড়া কোনো জায়গা বাদ নেই। ওপার – বাংলায় সর্বপ্রথম প্রেস স্থাপিত হয় রঙপুরে ১৮৪৭-এ। ঢাকায় ১৮৬০-এ। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে নানা জেলায়। উনিশ শতকে বাংলার বাইরে বাংলা বই ও পত্রিকা ছাপা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের বারাণসী, এলাহাবাদ, বিহারের বাঁকিপুর, জামালপুর, উড়িষ্যার কটক, আসামের গুয়াহাটি, নওগাঁ এবং আরও অন্যান্য স্থানে।