![]() |
বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব আলোচনা করো। |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
জীবন ও সম্পত্তিহানি: বিশ্বের বহু দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এই যুদ্ধে প্রায় ৬ কোটি লোক নিহত, ৮ কোটি আহত ও বিকলাঙ্গ এবং ২.৫ কোটি লোক বাস্তুহারা হয়। মানব সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও এই যুদ্ধে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল। তা ছাড়া শত্রুপক্ষের আক্রমণে উভয় পক্ষেরই ব্যাপক সম্পদ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা মানব সভ্যতাকে কলঙ্কিত করেছিল।
যুদ্ধ সম্পর্কে ভীতি ও শান্তির প্রয়াস: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষকে ব্যথিত করেছিল। তাই আগামী দিনে আর যাতে বিশ্ববাসী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি না হয় তাই পরবর্তীতে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিরবচ্ছিন্ন শান্তির প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সেই প্রয়াসের ফলশ্রুতি ছিল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠন।
দ্বিমেরু বিশ্ব ও ঠান্ডা লড়াই: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন এই দুই জোটে ভাগ হয়ে দ্বিমেরু বিশ্ব গঠন করে। ফলে মার্কিন পুঁজিবাদ ও রাশিয়ার সাম্যবাদের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দু শুরু হয়-যাঠান্ডা লড়াই এর পটভূমি তৈরি করে।
তৃতীয় বিশ্ব ও নির্জেটি আন্দোলন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলি ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই দেশগুলি মার্কিন পুঁজিবাদ বা সোভিয়েত সাম্যবাদ থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে চলার নীতি গ্রহণ করে-যা নির্জেটি বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নামে পরিচিত।
জাতীয়তাবাদের প্রসার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদ এক নতুন রূপ ধারণ করে। এই যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রসার ঘটে। এশিয়া ও আফ্রিকার পরাধীন দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে এই দেশগুলি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন করে।
অব-উপনিবেশবাদের বিকাশ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও পশ্চিমের দেশগুলিতে অব-উপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে গভীর ভাবে আন্দোলিত করেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিবিদ্বেষ ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অব-উপনিবেশবাদের অনিবার্য ফলশ্রুতি এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন।
সমাজতন্ত্রের প্রসার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একমাত্র রাশিয়াতেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু যুদ্ধাবসানে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি দেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশ, যুদ্ধাবসানে নিরবচ্ছিন্ন শান্তির প্রয়াসের অঙ্গ হিসেবে আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা, জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার নীতিতে আস্থা-আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশের সহায়ক হয়েছিল।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে ৫১ টি দেশের প্রতিনিধি মিলিত হয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U. N. O) গঠন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে বিশ্বে আপাত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও আদর্শবাদকে কেন্দ্র করে বিশ্ব আবার দুটি শক্তিধর দেশের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া) রেষারেষির মুখোমুখি { হয়-যা ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল।