বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ-চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – ভারতে ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয় তার প্রতীক হলেন ড. ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, কিন্তু এরও বহু আগে মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও ফুলে (১৮২৭-৯০ খ্রি)-র নেতৃত্বে ‘দলিত চেতনা’ বিকশিত হতে থাকে।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ-চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ পড়ে নেওয়া যাক।
বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ-চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
![]() |
বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ-চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ |
দলিত কথার অর্থ
‘দলিত’ শব্দটি আজকাল বহুল প্রচলিত। মারাঠি সাহিত্য থেকে কথাটি নেওয়া। বুৎপত্তিগতভাবে ‘দলন’ থেকে ‘দলিত ‘কথাটি এসেছে। ‘দলন’ মানে হল পিষ্ট করা, দমন করা, বলপূর্বক দমিয়ে রাখা। কাদের ‘দলিত’ বলা হবে- এ নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় প্রাচীন ভারতের হিন্দু সমাজে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার কথা। এই ব্যবস্থা অনুসারে হিন্দু সমাজে চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। শূদ্রদের কাজ ছিল তিন বর্ণের সেবা করা। কালক্রমে এই ব্যবস্থা জাতিভেদ ব্যবস্থায় পরিণত হয় এবং এর সঙ্গে অস্পৃশ্যতা জড়িয়ে পড়ে।
দলিত কে
- সংকীর্ণ অর্থে দলিত হল হিন্দু জাতিভেদ ও বর্ণভেদযুক্ত সমাজের অস্পৃশ্য অংশ। চতুর্বর্ণযুক্ত হিন্দুসমাজের বাইরে বা সর্বনিম্নস্তরে অবস্থানকারী শূদ্রদের নীচেও একটি স্তর আছে যাদের ‘অবর্ণ’ বা ‘অতিশূদ্র’ বলা হচ্ছে। বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ঘনশ্যাম শাহ তাই বলেন যে, ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু সমাজব্যবস্থার সর্বনিম্নস্তরে অবস্থানকারী মানুষদের ‘অতিশূদ্র’ বা ‘অবর্ণ’ বলা হচ্ছে এবং তারা অস্পৃশ্য বলে পরিগণিত। তাদের অস্পৃশ্য, পঞ্চম জাতি, ম্লেচ্ছ, চণ্ডাল প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়। অস্পৃশ্যতার দোহাই দিয়ে এইসব মানুষদের জমির মালিকানা, মন্দিরে প্রবেশের অধিকার- এমনকী গ্রামের পুকুর বা কুয়ো থেকে জল নেওয়ার মতো সাধারণ অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হত। গ্রামগুলিতে অস্পৃশ্য মানুষরা যাবতীয় দৈহিক পরিশ্রমের কাজ, যথা- ধাঙরের কাজ, ভিস্তিওয়ালার কাজ, মরা পশুর ছাল ছাড়ানোর কাজ, খেতমজুরের কাজ প্রভৃতি করত। এর বিনিময়ে তারা ভূস্বামী পরিবারগুলির কাছ থেকে ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ পেত।
- অনেকে আবার বর্তমান প্রশাসনিক পরিভাষায় ‘তপশিলী জাতি’ ও ‘তপশিলী উপজাতি’- ভুক্ত সকলকেই দলিত বলে আখ্যায়িত করতে চান। যদিও তপশিলী সমাজের সব অংশ দলিত পর্যায়ভুক্ত নয়। ‘দলিত’ মূলত হিন্দুদের বিষয় হলেও মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মীয় মানুষদের মধ্যেও এই জাতীয় মানুষের অস্তিত্ব দেখা যায়।
- তবে সাধারণভাবে পশ্চাদপদ ও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী জনগণকে এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এর মধ্যে পড়ে শোষিত দরিদ্র সমাজের প্রান্তিক নারী, শিশু, বৃদ্ধ, তপশিলি জাতি ও উপজাতি, আদিবাসী, অন্ত্যজ, হরিজন প্রভৃতি জনগোষ্ঠী।
আন্দোলনের বিকাশ
- ভারতে ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয় তার প্রতীক হলেন ড. ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, কিন্তু এরও বহু আগে মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও ফুলে (১৮২৭-৯০ খ্রি)-র নেতৃত্বে ‘দলিত চেতনা’ বিকশিত হতে থাকে। বস্তুতপক্ষে, তিনিই হলেন ভারতের আধুনিক অন্ত্যজ জাতিভুক্ত প্রথম চিন্তাবিদ। তাঁর জীবনীকার ধনঞ্জয় কীয়ের তাঁকে মহারাষ্ট্রের ‘সমাজ বিপ্লবের পিতা’ বলে অভিহিত করেছেন। হিন্দু সমাজের ‘অস্পৃশ্য’ এবং সমাজের অন্যান্য নিপীড়িত মানুষদের প্রতি তাঁর প্রবল সহমর্মিতা ছিল। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সামাজিক বিন্যাসের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ঐতিহাসিক ইস্তাহার ‘গুলামগিরি’। এই একই সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সত্যশোধক সমাজ’-এর উদ্দেশ্য ছিল কপটচারী ব্রাহ্মণ ও সুবিধাবাদী ধর্মশাস্ত্রগুলির হাত থেকে নিম্নবর্গের মানুষদের রক্ষা করা। তাঁর এই আন্দোলন ‘সত্যশোধক আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে বলা দরকার যে, উনিশ শতকে যখন অধিকাংশ সমাজ সংস্কার আন্দোলন ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, তখন ‘সত্যশোধক আন্দোলন’ ছিল গ্রামাঞ্চলভিত্তিক।
- দক্ষিণ ভারতে দলিত আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হলেন কেরলের শ্রীনারায়ণ গুরু। তাঁর নেতৃত্বে এভজ সম্প্রদায়ের আন্দোলন সুদৃঢ় ভিত্তি পায়।
- মাদ্রাজের অন্ত্যজরা ব্রাহ্মণ-বিরোধিতায় যতটা না অগ্রসর হয়, তার চেয়ে অব্রাহ্মণ জাতিগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষিত ও সম্পদশালী সম্প্রদায় অনেক বেশি এগিয়ে আসে।
- ১৯১৬ সালে ব্রাহ্মণ-বিরোধী জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- মাদ্রাজের ই. ভি. রামস্বামী নায়কার ‘আত্মমর্যাদা আন্দোলন’ সংগঠিত করে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন।
- মহারাষ্ট্রে কেশবরাও জেঠ-এর নেতৃত্বে একটি অব্রাহ্মণ সংগঠন মহাজন ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।
- ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে অনুন্নত সম্প্রদায়ের জনগণ মন্দিরে প্রবেশ ও অন্যান্য সামাজিক বৈষম্য নিরসনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে ত্রিবাঙ্কুর, ইন্দোর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যে অনুন্নত সম্প্রদায় মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পায়।
- ভারতে এই আন্দোলনের প্রতীক হলেন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ডঃ বি. আর. আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬ খ্রি.)। তিনি মহারাষ্ট্রের মাহার নামক অস্পৃশ্য শ্রেণিভুক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২০-র দশক থেকে তাঁর নেতৃত্বে মাহাররা একটি স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের দাবি ছিল পৃথক প্রতিনিধিত্ব, পুকুর ব্যবহার, মন্দিরে প্রবেশের অধিকার এবং গ্রামের মোড়লদের জন্য সেবাকার্যের বিলোপ। ১৯২৭ সালে তাদের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫তে তিনি গড়ে তোলেন ‘ভারত লেবার পার্টি’ এবং ১৯৪২-এ গঠিত হয় ‘সারা ভারত তপশীলি সম্প্রদায় ফেডারেশন’। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বক্তব্য ছিল, যতদিন ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত থাকবে, ততদিন অনুন্নত শ্রেণির সামাজিক ও আর্থিক মুক্তি সম্ভব নয়।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ-চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।