ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ

ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ – জার্মানির ওপর বেশ কিছু কঠোর অর্থনৈতিক শর্তাদি আরোপিত হয় এবং এ ব্যাপারে মিত্রপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল জার্মান অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। 
 
সুস্বাগতম প্রিয় শিক্ষার্থী। Prayaswb-এর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের সঙ্গে ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করবো।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ পড়ে নেওয়া যাক।

ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ

ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ
ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ

ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ

সূচনা

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই নভেম্বর জার্মানির আত্মসমর্পণের পর মিত্রশক্তি ও তার সহযোগী ৩২টি দেশের প্রতিনিধিরা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এক সম্মেলনে (১৯১৯ খ্রিঃ) মিলিত হন। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের ভবিষ্যৎ মানচিত্রের পুনর্বিন্যাস, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান এবং পরাজিত শক্তিগুলির সঙ্গে সন্ধির শর্তাদি নিরূপণ। এই সম্মেলনের প্রকৃত নিয়ন্তা ছিলেন চার রাষ্ট্রপ্রধান- মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ক্রেমেসো এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী অর্লান্ডো। এঁরা ‘চার প্রধান ‘নামে পরিচিত ছিলেন। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেসো ছিলেন এই সম্মেলনের সভাপতি। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর মিত্রপক্ষ পরাজিত দেশগুলির সঙ্গে পাঁচটি সন্ধি স্বাক্ষর করে। এই সন্ধিগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল জার্মানির সঙ্গে ভার্সাই-এর সন্ধি (২৮ জুন, ১৯১৯ খ্রিঃ)। সন্ধির লক্ষ্য ছিল জার্মানিকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা যাতে জার্মানি আগামীদিনে কোনোভাবে ইউরোপে মাথা তুলতে না পারে।

অর্থনৈতিক শর্তাবলি

জার্মানির ওপর বেশ কিছু কঠোর অর্থনৈতিক শর্তাদি আরোপিত হয় এবং এ ব্যাপারে মিত্রপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল জার্মান অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। 
  • যুদ্ধসৃষ্টির জন্য জার্মানিকে অপরাধী বলে ঘোষণা করে জার্মানির ওপর ৬৬০ কোটি পাউন্ডের বিপুল ক্ষতিপূরণের দাবি চাপিয়ে দেওয়া হয়। 
  • জার্মানি তার বড় আকারের অধিকাংশ বাণিজ্যপোত ফ্রান্স এবং যুদ্ধ জাহাজগুলি ইংল্যান্ডকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 
  • জার্মানির মোট ৬৭টি কয়লাখনির মধ্যে ৫৩টি কয়লাখনি, ১৬টি জিঙ্ক এবং ১১টি সিসার খনি পোল্যান্ডের অধীনে যায়। 
  • ফ্রান্সের কয়লাখনিগুলি ধ্বংসের অভিযোগে কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ জার্মানির সার অঞ্চলটি আগামী ১৫ বছরের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। স্থির হয় যে, আগামী ১৫ বছর এই অঞ্চলের কয়লাখনিগুলি ফ্রান্সের অধীনে থাকবে এবং ১৫ বছর অতিক্রান্ত হলে এই অঞ্চলের জনগণ গণভোটের দ্বারা স্থির করবে যে, তারা কোন রাষ্ট্রে যোগ দেবে। 
  • ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গকে জার্মানি এক বিশেষ ধরনের কয়লা, লোহা, কাঠ, রবার ও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে। 
  • জার্মানি মিত্রপক্ষকে ৫ হাজার রেল ইঞ্জিন এবং দেড় লক্ষ মোটর গাড়ি দিতে বাধ্য থাকবে। 
  • মিত্রশক্তির দ্বারা উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য বিক্রয়ের জন্য জার্মানির বাজারে মিত্রপক্ষ অগ্রাধিকার পাবে। 
  • জার্মানির বাইরে জার্মান নাগরিকদের সম্পত্তি মিত্রপক্ষ বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। 
  • শ্যাম, মরক্কো, লাইবেরিয়া, মিশর, তুরস্ক, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশে অবস্থিত সম্পত্তি ও ‘বিশেষ অধিকার’ জার্মানি ত্যাগ করবে। 
  • জার্মানির এলবা, ওডার, নিয়েসেন, রাইন ও দানিয়ুব নদী এবং কিয়েল খাল আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে।

সমালোচনা

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত ভার্সাই সন্ধি সমকালে ও পরবর্তীকালে নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে- বস্তুত আধুনিক যুগের ইতিহাসে এমন বিতর্কিত চুক্তি খুব কমই দেখা যায়। অনেকে এই সন্ধিকে একটি ‘মৃত্যু পরিকল্পনা’ ও ‘দাসত্বের শৃঙ্খল’ বলে অভিহিত করেন। জার্মান ঐতিহাসিকরা এই সন্ধিকে ‘একতরফা ও জবরদস্তিমূলক সন্ধি’ (‘Dictated Peace’) বলে অভিহিত করেছেন। এই সন্ধির অর্থনৈতিক তাৎপর্যের কথা বলতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা বলেন যে, জার্মানির ওপর যে অর্থনৈতিক শর্তাদি আরোপিত হয় তা ছিল চরম অবাস্তব। ঐতিহাসিক ল্যাংসাম (Langsam) বলেন যে, এই সন্ধির ফলে জার্মানিকে ২৫ হাজার বর্গমাইল অঞ্চল, ৭০ লক্ষ জনসমষ্টি, ১৫ শতাংশ চাষযোগ্য জমি, ১২ শতাংশ পশুসম্পত্তি ও ১০ শতাংশ বৃহদায়তন শিল্প হারাতে হয়। তার কয়লার শতকরা ৪০ ভাগ, লোহার শতকরা ৬৫ ভাগ এবং উৎপাদিত রবারের প্রায় সবটাই মিত্রপক্ষকে দিয়ে দিতে হয়। খনিজসম্পদে পূর্ণ সার অঞ্চল হস্তচ্যুত হয় এবং নদীগুলি প্রায় সবই আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এভাবে জার্মান অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়ার পরেও তার ওপর চাপানো হয় ক্ষতিপূরণের বিশাল বোঝা, যা বহন করার শক্তি জার্মানির ছিল না। উইনস্টন চার্চিল ভার্সাই সন্ধির এই অর্থনৈতিক শর্তাবলিকে ‘এক বিরাট অর্থহীন ও অবাস্তব’ শর্ত বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক জে. এল. কারভিন বলেন যে, সমস্যা সমাধানের নামে ভাসাই সন্ধি দ্বারা নতুন সমস্যার উদ্ভাবন করা হয়েছিল।

ফলাফল

ভার্সাই চুক্তির অর্থনৈতিক ফলাফল আলোচনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. এম. কেইনস-এর মত উল্লেখযোগ্য। তিনি ভার্সাই চুক্তির অর্থনৈতিক শর্তের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর মতে যুদ্ধের পূর্বে ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব বিকাশ হয়েছিল। এই দেশগুলি নিজেদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য উন্নত জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করার সঙ্গেঙ্গ সঙ্গে প্রচুর মূলধন রপ্তানিও করত। যুদ্ধের ফলে ছবিটি সম্পূর্ণ পালটে যায়। মহাদেশের বড় অংশে অর্থনীতি মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য ও শিল্পপণ্যের সরবরাহ ছিল অপর্যাপ্ত। এই অবস্থায় ভার্সাই চুক্তির অর্থনৈতিক শর্তসমূহ শুধু জার্মানিকে নয়, গোটা ইউরোপকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আন্তঃ- রাষ্ট্রিয় ঋণের সমস্যা মেটানো যায় নি। জার্মানির ওপর বিরাট ক্ষতিপূরণের বোঝা ও অন্যান্য শর্তাদি চাপানোর ফলে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা লুপ্ত হয়েছিল। তাঁর মতে যুদ্ধের ফলে ইউরোপে ‘সুখের যুগের’ অবসান হয়েছিল।

আমরা মনে করি আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। ভার্সাই চুক্তি-অর্থনৈতিক সমীকরণ -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment