ভূমিদাস প্রথার অবসান ও গুরুত্ব বা ফলাফল

ভূমিদাস প্রথার অবসান ও গুরুত্ব বা ফলাফল
ভূমিদাস প্রথার অবসান ও গুরুত্ব বা ফলাফল

রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের উদ্যোগে ভূমিদাস প্রথার অবসান

ভূমিদাসদের অবস্থা

উনিশ শতকের মধ্যভাগে রাশিয়ায় এক স্বৈরতন্ত্রী, সামন্ততান্ত্রিক ও মধ্যযুগীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন স্বৈরচারী জার। জার ছিলেন সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতার আধার। এই শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল ‘স্বৈরাচার, অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতি’। এ সময় রুশ সমাজ দুভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে ছিল মুষ্টিমেয় অভিজাতশ্রেণি এবং অপরদিকে ছিল অগণিত দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ ছিল কৃষক।

এই কৃষকদের প্রায় অর্ধেক ছিল ভূমিদাস বা ‘সাফ’। বাকি কৃষকদের অধিকাংশই ছিল অতি দরিদ্র, কিন্তু স্বাধীন কৃষক। ভূমিদাস প্রথা ছিল রাশিয়ার এক অতি প্রাচীন প্রথা এবং তা ছিল রাশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অন্যতম ভিত্তি। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ভূমিদাসদের মুক্তির আইন প্রবর্তিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে রাশিয়ায় ভূমিদাসদের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি। এর মধ্যে ২ কোটির কিছু কম ভূমিদাস ছিল জারের অধীন, ২ কোটির কিছু বেশি ছিল অভিজাতদের অধীন এবং অবশিষ্ট অর্ধ-কোটি ছিল গির্জার অধীন বা গৃহভৃত্য। রুশ ভূমিদাসদের অবস্থা ছিল অতি শোচনীয়। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের ভূমিদাসরা সর্বদা ভূমির সঙ্গেই যুক্ত ছিল- কখনই তাদের ভূমি বা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেত না। রাশিয়ার ভূমিদাসদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তারা ছিল মালিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং তাদের অবস্থা ছিল ক্রীতদাসদের মতোই। মালিক তাদের ইচ্ছামতো কেনা-বেচা ও হস্তান্তর করতে পারত, বন্ধক রেখে ঋণ নিতে পারত, জুয়াখেলায় বাজি রাখতে পারত, ভাড়া খাটাতে পারত- এমনকি কলকারখানা, খনি ও যুদ্ধের কাজে নিয়োগ করতে পারত। মালিকই ছিল তাদের সর্বময় কর্তা। ভূমিদাসকে তার মালিকের জমিতে বেগারে খাটতে হত এবং তাকে নানা ধরনের কর দিতে হত। বিনিময়ে সে পেত সামান্য এক টুকরো জমি যার ওপর কখনই ভূমিদাসদের মালিকানা বা দখলি স্বত্ব স্থাপিত হত না বা এই জমি কখনই ভূমিদাস ও তার পরিবারের জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। এইভাবে বংশানুক্রমিকভাবে চরম দুর্দশা, নিপীড়ন ও দারিদ্রের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারহীন অবস্থায় ভূমিদাসদের জীবন কাটাতে হত। বলা যায় যে, আমেরিকার বাগিচাগুলিতে কর্মরত নিগ্রোরাও রশিয়ার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূমিদাসদের চেয়ে সুখী ছিল।

ভূমিদাস প্রথার অপ্রয়োজনীয়তা

উনিশ শতকের সূচনা থেকে রাশিয়ায় শিল্পায়নের সূচনা, বাণিজ্যের বিস্তার কৃষিকার্যে নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন প্রভৃতি কারণে ভূমিদাস প্রথার অপ্রয়োজনীয়তা সর্বসমক্ষে প্রকট হয়ে ওঠে।

ক্রমিক কৃষক বিদ্রোহ: স্বৈরাচারী জার-শাসনাধীন রাশিয়ায় নির্যাতিত ভূমিদাসদের ঘন ঘন বিদ্রোহ জার-সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। জার প্রথম নিকোলাসের (১৮২৫-৫৫ খ্রিঃ) প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের বিরুদ্ধে বুশ জাতীয়তাবাদীরা একাধিক গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলে। তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জারের স্বৈরতন্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত করা এবং ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ। কেবল এই নয়- জার প্রথম নিকোলাসের রাজত্বকালের শেষ দশ বছরে (১৮৪৫-৫৫ খ্রিঃ) অন্তত চারশটি কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এবং তাঁর রাজত্বকালের কুড়ি বছরের (১৮৩৫-৫৪ খ্রিঃ) মধ্যে অন্তত ২৩০ জন ভূস্বামী বা তাদের কর্মচারী ভূমিদাসদের হাতে নিহত হয়। পরবর্তী জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের রাজত্বের প্রথম ছয় বছরে (১৮৫৫-৬০ খ্রিঃ) অন্তত চারশটি কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সব দিক বিবেচনা করে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (১৮৫৫-৮১ খ্রিঃ) ভূমিদাস প্রথা বিলোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

মুক্তির ঘোষণাপত্র

দ্বিতীয় আলেকজান্ডার উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই প্রথা যুগের অনুপযোগী এবং তা উচ্ছেদ করা একান্ত প্রয়োজন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের এক নির্দেশনামায় তিনি লিথুয়ানিয়া প্রদেশের সব ভূমিদাসকে মুক্তি দেন। জমিদাররা এর প্রবল বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত সরকারি চাপের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। অতঃপর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে ফেব্রুয়ারি (নতুন বর্ষপঞ্জী অনুসারে ৯ই মার্চ) তিনি বিখ্যাত ‘মুক্তির আইন’ বা ‘মুক্তির ঘোষণাপত্র’-তে স্বাক্ষর করেন এবং এর ফলে সমগ্র রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ হয়। যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত ভূমিদাসদের দাসত্ববন্ধন থেকে মুক্তি দেবার জন্য তিনি ইতিহাসে ‘মুক্তিদাতা জার’নামে পরিচিত হন।

ফলাফল

‘মুক্তির ঘোষণাপত্র’ বা ভূমিদাসদের মুক্তি রাশিয়ার ইতিহাসে এক অতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। 
  • রুশ ইতিহাসের এক মধ্যযুগীয় কুপ্রথার অবসান ঘটে এবং রাশিয়ায় আধুনিক যুগের সূচনা হয়। ভূমিদাসদের ওপর থেকে সামন্তপ্রভু বা জমিদারদের কর্তৃত্বের অবসান হয় এবং তারা মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করে। তারা ইচ্ছামতো স্থানান্তর গমন, চুক্তি সম্পাদন, জীবিকা পরিবর্তন এবং অন্যান্য অধিকার অর্জন করে। 
  • কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি ঘটে, কৃষির সম্প্রসারণ হয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, জমির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, রাজস্ব খাতে সরকারের আয় বৃদ্ধি পায় এবং বহির্বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। 
  • এই প্রথার অবসানের ফলে রাশিয়ায় শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। মুক্ত ভূমিদাসরা শ্রমিক হিসেবে কলকারখানা, খনি, যানবাহন প্রভৃতি শিল্পে নিযুক্ত হতে থাকে। এর ফলে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের সূচনা হয়, কায়িক শ্রমনির্ভরতার স্থলে যান্ত্রিক শ্রমনির্ভরতা দেখা দেয় এবং রাশিয়ায় সংঘবন্ধ শ্রমিকশ্রেণির উন্মেষ ঘটে।

Leave a Comment