মহাকাশ গবেষণা ও ভারত রচনা

মহাকাশ গবেষণা ও ভারত রচনা
মহাকাশ গবেষণা ও ভারত রচনা

ভূমিকা

বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে একসময়ের দরিদ্র দেশ ভারত বর্তমানে মহাকাশ অভিযানে যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে, তা যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের কাছে শ্লাঘার বিষয়। এই মহাকাশ অভিযানের ফলে বিশ্ব যেমন কাছে এসে গিয়েছে, তেমনি মহাকাশ সম্পর্কিত বিষয় ও আধুনিক জীবনকে আরো গতিশীল করে তুলতে তা সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

বর্তমান

ইসরোর (ISRO-Indian Space Research Organisation) চেয়ারম্যান জানিয়েছেন মহাকাশে এক কেজি জিনিস পাঠাতে ২০০৭ সালে যেখানে ৫০০০ ডলার খরচ হত তা আগামী ২০৩০-২০৫০ সালের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াবে মাত্র ৫০০ ডলার। এমনকি আমেরিকাও মনে করে, রিমোট সেনসিং (Remote Sensing)-এর ক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে ভারত অন্যতম দেশ। গত তিন বছরে ভারত মহাকাশ প্রযুক্তি বিষয়ক জিনিস বাইরের দেশে (যার মধ্যে আমেরিকা নিয়েছে ৭ লক্ষ ডলার মূল্যের জিনিস) পাঠিয়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকা লভ্যাংশ পেয়েছে-যা পূর্বের বছরগুলি থেকে তিনগুণ। এই তথ্য প্রমাণ করে ভারতের মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যৎ কতটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

সূচনা

প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ভাস্করাচার্য প্রমুখ মহাকাশ গবেষণায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন। আধুনিক ভারতে মহাকাশ গবেষণার সূচনা ১৯৬২-র ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৩-র ২১ নভেম্বর কেরালার থুম্বা থেকে দু-স্তর বিশিষ্ট বড় মাপের রকেট প্রথম উৎক্ষিপ্ত হয়। ঐ বছর থুম্বায় স্থাপিত হয় ERLS (Equatorial Rocket Launching Station) এবং মহাকাশ গবেষণা সংস্থাও (ISRO) গড়ে ওঠে। এরপর ভারতে গড়ে ওঠে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার (VSSC)। ভারতের প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপক রকেট এস এল ভি-৩ (SLV-3) এই কেন্দ্রের অবদান।

মহাকাশযাত্রায় সাফল্য

১৯ এপ্রিল, ১৯৭৫ ভারতের মহাকাশ যাত্রার সাফল্যের সূত্রপাত-সেদিন সোভিয়েত রাশিয়ার উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে সোভিয়েত রকেটের সাহায্যে ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ আর্যভট্ট উৎক্ষেপণ করা হয়। এরপর ৭ জুন, ১৯৭৯-এ হরিকোটা থেকে SLV-3 উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হয়-যার ক্ষতির মূল্য ছিল তিন কোটি টাকা। ১৯৮০, ১৮ জুলাই SLV-3 রকেট মারফত রোহিনীর উৎক্ষেপণ হয়। ১৯৮১, ২০ নভেম্বর সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় ভাস্কর-২ এর উৎক্ষেপণ হয়। ১৯৮২, ১০ এপ্রিল রুশ রকেটে চেপে পাড়ি দেয় ইনস্যাট-১এ। ১৯৮৩, ৩০ আগস্ট ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে ইনস্যাট-১বি মহাকাশে পাড়ি দেয়। ১৯৮৪, ৩ এপ্রিল কাজকাস্তানের বৈকানুর উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে সয়ুজ T-II-এ চড়ে দুই রুশ মহাকাশ যাত্রী ম্যালিশেভ ও স্ট্রেকালভ-এর সঙ্গে ভারতীয় নভযাত্রী রাকেশ শর্মা মহাকাশে পাড়ি দেন ও ১১ এপ্রিল ফিরে আসেন। তারপর ১৯৯১-তে IRS-IB মহাশূন্যে পাড়ি দেয়, ১৯৯২-তে SROSS III-কে সঙ্গে নিয়ে ASLV-D3 সাফল্যের সঙ্গে পাড়ি দেয়। ইনস্যাট সিরিজের উপগ্রহগুলিও মহাকাশ গবেষণায় সাফল্য এনে দিয়েছে, এর মধ্যে ইনস্যাট থ্রি-ই ২৭৭৫ কেজি ওজনের উপগ্রহ-যার স্থায়িত্ব পনের বছর। মহাকাশ গবেষণায় ‘অগ্নি’ অন্যতম সংযোজন (১৯৮৯, ২২ মে) যার দ্বারা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্র মজবুত হয়েছে এবং এর দ্বারা অত্যাধুনিক মিসাইল প্রয়োগে সার্থক হবে ভারত। সেপ্টেম্বর ২০১৩-তে অগ্নি-৫ উৎক্ষেপণ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করল।

সাম্প্রতিক সাফল্য

২০১২ সাল ভারতের মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২ PSLV (Polar Satellite Launch Vehicle)-এর উৎক্ষেপণ স্মরণীয়। কেননা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে এই অভিযান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে-যার ফলে ভারত মহাকাশ গবেষণায় বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে পৌঁছে গেছে। ভারত এর দ্বারা আগামী পাঁচ বছরে মহাকাশে ভারী রকেট পাঠাতে পারবে, পরিবেশের বিভিন্ন বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, আবহাওয়া পরিবর্তনের খুঁটিনাটি জানতে পারবে এবং জীবনদায়ী নানা দিকের খবর জানাতে সক্ষম হবে। আমেরিকার মতে, PSLV পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম উপগ্রহ। এছাড়া IRS-IC এবং IRS-ID এর দ্বারা পাওয়া তথ্য শুধু ভারতে নয় রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই প্রভৃতি দেশের ক্ষেত্রেও কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করেছে। আবার INSAT-3B ও 3G, GSAT যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। GSLVও নানা তথ্য পাঠাচ্ছে। ৫ নভেম্বর ২০১৩ ভারত একক এবং একবারের প্রচেষ্টায় মঙ্গল গ্রহে মহাকাশ যান প্রেরণ করে এবং নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট মেনে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে মহাকাশ যানকে স্থাপন করতে সক্ষম হয় ও মঙ্গলের ছবিও ইসরোর বিজ্ঞানীদের হাতে চলে আসে। জাপান, চিন, রাশিয়া যা পারেনি, আমেরিকাও যা একবারে পারেনি, ভারত সেই কীর্তি স্থাপন করে মহাকাশ গবেষণায় তার যোগ্যতা প্রমাণ করল। সাম্প্রতিককালে ২০১৮-র ১২ জানুয়ারি PSLV-31, ২৯ মার্চ GSAT-6A স্যাটেলাইট, ১২ এপ্রিল PSLV-C41 স্যাটেলাইট, ২৫ এপ্রিল GSAT- II উৎক্ষেপণ, ১৬ সেপ্টেম্বর PSLV-C42-এর সফল উৎক্ষেপণ মহাকাশ গবেষণার উল্লেখযোগ্য সাফল্যের নিদর্শন।

গুরুত্ব

যে ভারত বাইরের দেশের প্রযুক্তি ও গবেষণা কেন্দ্র ব্যবহার করে মহাকাশ গবেষণার কাজ শুরু করেছিল, সেই ভারত আজ বাইরের বহু রাষ্ট্রকে বহুভাবে এ ব্যাপারে সাহায্য করছে এবং একটা দিক নির্দেশকের ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশেষ করে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস, জলে স্থলে লুকোনো সম্পদের সন্ধান, বেতার দূরদর্শন ও টেলি যোগাযোগ, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, শত্রুদেশের উপর নজরদারি, সমুদ্র বায়ু প্রবাহের গতিবেগ ও দিক নির্ণয়, সমুদ্র তলের তাপমাত্রা নির্ণয়, সারা দেশে জল ও অরণ্য সম্পদের পরিমাণ নির্ণয়, এক্সরে, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সৌর পদার্থ বিজ্ঞান, ঊর্ধ্বাকাশের আবহাওয়া প্রভৃতি সম্পর্কে দেশ অনেক তথ্য জানতে পারছে।

উপসংহার

আমেরিকার নাসা-র সাফল্য পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক হলেও ভারত কিন্তু চতুর্থ স্থানে পৌঁছে গেছে। মহাকাশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানব কল্যাণে ভারত যথেষ্ট সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছে। এমনকি ভারত স্বাধীনভাবে ১৩৫০ কেজি ওজনের মঙ্গলযান লাল গ্রহের কক্ষপথে প্রেরণ করেছে-যার দ্বারা মঙ্গলগ্রহে প্রাণের সন্ধান করা যাবে। ফলে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ভারত যে আগামী দিনে আরো নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে পারবে ভারতবাসী হিসেবে সেই প্রত্যাশা করতেই পারি।

Leave a Comment