মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে – 1857 খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তা ইতিহাসে মহাবিদ্রোহ নামে পরিচিত। মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে।

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে
মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে

সূচনা

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নেই। অনেকের মতে এটি ছিল নিছক একটি সামরিক বিদ্রোহ। অনেকে আবার ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকের মতে, এটি ছিল নিছক একটি সামন্ত বিদ্রোহ। ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আউট্রাম একে ‘মুসলমানদের ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। বড়োলাট ক্যানিং এর মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন ‘ব্রাহ্মণদের প্ররোচনা ও অন্যান্যদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি’।’ অনেকের মতে এটি ছিল কৃষক বিদ্রোহ।

সিপাহী বিদ্রোহ

স্যার জন লরেন্স (Sir John Lawrence), স্যার জন সিলি (Sir John Seeley), চার্লস রেকস্ (Charles Raikes), আর্ল রবার্টস (Earl Roberts) প্রমুখ ইংরেজ ঐতিহাসিকের মতে, এই বিদ্রোহ একটি সামরিক বিদ্রোহ ব্যতীত অপর কিছু ছিল না। সমকালীন বিদগ্ধ ভারতীয়দের মধ্যে প্রায় সকলে অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কিশোরীচাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজি, সৈয়দ আহমদ, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিশোরীচাঁদ মিত্র বলেছেন, “এই – বিদ্রোহ ছিল একান্তভাবেই সিপাহিদের অভ্যুত্থান। এতে গণ-আন্দোলনের কোনো উপাদান ছিল না।” দেশীয় কোনো রাজনৈতিক সংগঠন এই বিদ্রোহ সমর্থন করেনি। শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহের নিন্দা করেছেন, ভারতের ব্যাপক অঞ্চলে বিদ্রোহের কোনো প্রভাব পড়েনি এবং দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গেও বিদ্রোহের কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। এই কারণে এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ বলা হয়।

‘সিপাহি বিদ্রোহ’ আখ্যা যুক্তিযুক্ত নয়

এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করা যুক্তিসম্মত নয়। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে আলোচনাকালে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে টোরি পার্টির নেতা ডিসরেলি (Disraeli) এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেন। সমকালীন ইংরেজ ঐতিহাসিক নর্টন (Norton), ডাফ (Duff), আউট্রাম (Outram), ম্যালেসন (Malleson), জন কে (John Kaye), চার্লস বল (Charles Ball), হোমস (Holmes) এই – বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিশিষ্ট মনীষী কার্ল মার্কস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, ব্রিটিশ শাসকরা “যাকে সামরিক বিদ্রোহ বলে ভাবছে, আসলে সেটা একটা জাতীয় বিদ্রোহ।” তিনি আবার অন্যত্র বলেছেন, “বর্তমান ভারতীয় অশান্তিটা সামরিক হাঙ্গামা নয়- জাতীয় বিদ্রোহ।” তাঁর মতে, সিপাহিরা জাতীয় বিদ্রোহের ‘ক্রিয়াশীল হাতিয়ার মাত্র’। এই বিদ্রোহ কেবল সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না-বরং এর একটি গণ-চরিত্র ছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানের জনসাধারণ-বিশেষত অযোধ্যা, বুন্দেলখণ্ড, রোহিলখণ্ড ও বিহারের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগদান করে। বিভিন্ন ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে অযোধ্যায় ইংরেজ শাসন কার্যত অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী ভূ-ভাগে এমন কোনো মানুষ ছিল না যে, ইংরেজ-বিরোধী নয়। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং প্রমুখ রাজন্যবর্গ, বহু জমিদার ও তালুকদার এই বিদ্রোহে যোগ দেন। বিদ্রোহীরা দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে ভারতে বিদেশি প্রভাবমুক্ত এক দেশীয় শাসনব্যবস্থা স্থাপনে উদ্যোগী হয়। সুতরাং এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ বলা অযৌক্তিক।

রজনীগুপ্ত এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, সিপাহিরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ কামনা করেছিল।

প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ

বীর সাভারকর (V. D. Savarkar) প্রমুখ লেখক এই বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। বলা বাহুল্য, এই মত-ও গ্রহণযোগ্য নয়। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম- প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়।’ তাঁর মতে, এই বিদ্রোহে ভারতের সকল অঞ্চলের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেনি। ভারতের কয়েকটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিল।

সমালোচনা

ভারতের বেশ কিছু নৃপতি বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করেন। শিখ ও গুর্খা সৈনিকরা সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের পক্ষে ছিল। সমগ্র দাক্ষিণাত্য এবং বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিলেন। পাঞ্জাব, সিন্ধুদেশ ও রাজপুতানায় এই বিদ্রোহের সামান্যতম কোনো স্ফুরণ দেখা যায়নি। বিদ্রোহীদের নৃশংসতা ও লুঠতরাজে সাধারণ জনসাধারণ তাদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মহারাষ্ট্র অঞ্চলে বিদ্রোহের ক্ষীণ প্রকাশ দেখা যায় মাত্র। বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সাময়িকভাবে সাফল্য লাভ করলেও, কেবল অযোধ্যাতেই তা ‘জাতীয় রূপ’ ধারণ করে। বিদ্রোহ চলাকালে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য দূরে থাকুক, অনেক স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে এবং সম্রাট হিসেবে বাহাদুর শাহের স্বীকৃতিতে শিখ, রাজপুত ও মারাঠারা ক্ষুব্ধ হয়। এই মহাবিদ্রোহে বিদ্রোহীদের লক্ষেরও কোনো স্থিরতা ছিল না। বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ সকলেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি। এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে আখ্যা দিলে এর পূর্ববর্তী ওয়াহাবি বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ ও অন্যান্য বিদ্রোহগুলিও সেই একই গৌরব দাবি করতে পারে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার (Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857), ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন (Eighteen Fifty Seven), ও ড. শশীভূষণ চৌধুরী (Civil Rebellion in the Indian Mutinies, 1857-59) এই বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের মতামতের অবতারণা করেছেন। তাঁরা এই বিদ্রোহকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলেননি, তবে কোনো কোনো অঞ্চলে জনগণের সমর্থনে তা জাতীয় বিদ্রোহের স্তরে উন্নীত হয়। ড. সেন বলেন যে, সামরিক বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হলেও কোনো কোনো স্থানে তা জাতীয় বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। ড. মজুমদার-এর মতে বিভিন্ন এলাকায় এর প্রকৃতি ছিল বিভিন্ন ধরনের।

সমালোচনার উত্তর

বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিক অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বিদ্রোহকে ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ ও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ বলেই অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক সুশোভন সরকার নানা যুক্তি সহকারে ও অতি সুদৃঢ়ভাবে ড. মজুমদার ও ড. সেনের বক্তব্য খণ্ডন করে বলেন যে, কোনো বিদ্রোহে সুপরিকল্পিতভাবে সকল শ্রেণির মধ্যে অভ্যুত্থানের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। তিনি বলছেন যে, এটি খুবই পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা রাজপুতদের বীরত্ব, শিবাজির-অভ্যুত্থান বা আকবরের শাসননীতিতে জাতীয়তাবাদী ভাব দেখলেও ১৮৫৭-র বিদ্রোহে তার কোনো চিহ্ন দেখতে পান না। তাঁর মতে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ জাতীয় সংগ্রাম না হলে ইতালির কার্বোনারি আন্দোলন, জোয়ার অব আর্কের নেতৃত্বে ফ্রান্স থেকে ইংরেজ বিতাড়নের যুদ্ধ বা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বুশ কৃষকদের যুদ্ধকেও জাতীয় সংগ্রাম বলা যাবে না। পি. সি. যোশী-ও তাঁর ‘1857 in Our History’ প্রবন্ধে অনুরূপ মতামত প্রকাশ করেছেন। অপরপক্ষে বিশিষ্ট মার্কসবাদী রাজনৈতিক নেতা ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ মূলত ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের সুরেই তাঁর বক্তব্য রেখেছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত তাঁর সুবিশাল গ্রন্থে (‘A History of Indian Freedom Struggle’) তিনি বলেছেন যে, এই বিদ্রোহে যত সংখ্যক সৈন্য যোগদান করেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি সৈন্য বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করে এবং এ কারণেই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। ভারতীয় সেনাদের সাহায্য না পেলে ব্রিটিশদের পক্ষে বিদ্রোহ দমন করা অসম্ভব হত। তিনি বলছেন যে, “বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা ও জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা যখন ১৮৫৭-৫৯ সালের সংগ্রামকে ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেন, তখন বুঝতে হবে যে তাঁরা এই সত্যটার দিকে চোখ বুজেই আছেন।’

সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ

জওহরলাল নেহরু, রজনীপাম দত্ত, এম. এন. রায় এবং ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ এই বিদ্রোহকে সামন্তশ্রেণির বিদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হন। তাঁদের মতে-এই বিদ্রোহ হল ভারতীয় সনাতনপন্থীদের শেষ বিদ্রোহ। ড. মজুমদার-এর মতে-এই বিদ্রোহ ক্ষয়িষ্ণু অভিজাততন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্তশ্রেণির ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’। তাঁর মতে, এই বিদ্রোহ স্পষ্টতই ছিল ‘প্রতিক্রিয়াশীল’। ড. সেন-এর মতে, সিপাহি বিদ্রোহের নেতাদের লক্ষ ছিল ‘প্রতি-বিপ্লব’। তাঁদের মতে ইংরেজ শাসনের অধীনে দ্রুত পাশ্চাত্য সভ্যতার বিস্তারে দেশীয় জনসাধারণ ও সামন্ত প্রভুদের মনে এক ভীতির উদ্রেক হয়। প্রাচীনপন্থী এই সং সামন্ত প্রভুদের হাতেই ছিল বিদ্রোহের নেতৃত্ব। সিপাহিরা জয়যুক্ত হলে তাঁরা নিশ্চয়ই পুরাতন ভারতীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করে ভারতে এক প্রতি-বিপ্লবের সূচনা করতেন। মনে হয়, এই কারণেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় সম্প্রদায় এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। বলা বাহুল্য, এই মতও সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেন যে, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, হজরৎ মহল, কুনওয়ার সিং প্রমুখ সামন্ত-জমিদার ও তালুকদারদের হাতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব ছিল বলে এই বিদ্রোহকে কখনই সামন্ত বিদ্রোহ ও প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া যায় না। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং তাঁরাই ছিলেন সমাজের ‘স্বাভাবিক নেতা’। এই কারণে এই অভ্যুত্থানও সামন্ত-প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তাঁর মতে, অভ্যুত্থান জয়যুক্ত হলে তা রক্ষার জন্য সামন্ত-প্রভাব মুক্ত নতুন শক্তির, নতুন কৌশলের ও নতুন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটত। তিনি বলেন যে, সামন্তব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ রাজন্যবর্গের একজনও বিদ্রোহে যোগ দেননি এবং অযোধ্যার বাইরে জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। বিদ্রোহে যোগদান করা দূরে থাক-প্রকৃত সামন্ত নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহ বানচাল করতেই ব্যস্ত ছিলেন। সুতরাং এই বিদ্রোহকে কখনই সামন্ত বিদ্রোহ বলা যায় না। পি. সি. যোশী নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বুশ-সামন্ত, পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে পোল-সামন্ত, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে মাৎসিনী, গ্যারিবন্ডি, ক্যাভূর ও ভিক্টর ইম্যানুয়েলের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে সামন্তদের গৌরবজনক ভূমিকা থাকলেও ভারত ইতিহাসেও তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁর মতে, সামন্ত-নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও ১৮৫৭-র বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সংগ্রাম।

উপসংহার

এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ, সামন্ত বিদ্রোহ বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা ঠিক হবে না। কেবল ধর্মীয় কারণ বা এনফিল্ড রাইফেলের টোটার জন্যই এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। এই বিদ্রোহ হল মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ মানুষ। বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে তারা বিদ্রোহে যোগ দিতে বাধ্য করে। নানা ত্রুটি, নানা গোলযোগ, নানা বিদ্বেষ সত্ত্বেও এই বিদ্রোহের গণ-চরিত্রকে কখনই অস্বীকার করা যায় না বা একে স্বাধীনতা সংগ্রাম বললেও অত্যুক্তি হয় না। জ হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক রণজিৎ গুহ, অধ্যাপক গৌতম ভদ্র, ড. রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ গবেষক এই বিদ্রোহে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব দান ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। আসলে এই মহাবিদ্রোহ নানা জনের কাছে প্রতিভাত হয়েছে নানাভাবে। অধ্যাপক এরিখ স্টোক্স (Eric Stokes) বলেন যে, এই বিদ্রোহ এক সুরে বাঁধা ছিল না। এর মধ্যে ছিল নানা ধারা, উপধারা, যেমন কৃষকদের প্রতিরোধ, তেমনি জাতীয় প্রতিরোধ। নানা তরঙ্গ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে একত্রিত হয়েছিল। কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক বেইলি (C.A. Bayly)-র মতে, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ নিছক একটি মাত্র আন্দোলন ছিল না- কেবল কৃষক বিদ্রোহ বা জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম নয়। এর নানা রূপ ছিল।

FAQs On – মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলােচনা করাে

মহাবিদ্রোহ কত সালে সংঘটিত হয়েছিল ?

মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে ।

লখনৌতে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কে ?
লখনৌতে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন  বেগম হজরত মহল ।
সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ কে ?
সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ মঙ্গল পান্ডে ।
মহাবিদ্রোহের সময় মুঘল সম্রাট কে ছিলেন ?
মহাবিদ্রোহের সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন বাহাদুর শাহ ।

Leave a Comment