যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সড়কপথ, জলপথ, রেলপথ, সুয়েজখাল ও টেলিগ্রাফের ভূমিকা

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সড়কপথ, জলপথ, রেলপথ, সুয়েজখাল ও টেলিগ্রাফের ভূমিকা
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সড়কপথ, জলপথ, রেলপথ, সুয়েজখাল ও টেলিগ্রাফের ভূমিকা
শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। রাস্তাঘাট ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া মাল চলাচল বা পণ্য পরিবহণে নানা সমস্যা দেখা দিত। সত্যি কথা বলতে কী, উন্নত ধরনের রাস্তাঘাট তৈরি হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটে যায়।

সড়ক ও জলপথ

সব ঋতুতে সড়ক পথে পণ্য চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য টেলফোর্ড ও – ম্যাকাডাম ইট, পাথর ও গলান পিচের সাহায্যে রাস্তা তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন (১৮১১ খ্রিঃ)। এর ফলে পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিপ্লব সংগঠিত হয়ে যায়। পরিবহনের ক্ষেত্রে জলপথ-ও সুবিধাজনক ছিল। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন খাল ও ক্যানালগুলিতে নৌকা দ্বারা পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়। এ কারণে অধ্যাপক ফিলিস ডিন এই যুগকে ‘ক্যানাল পরিবহনের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফুলটন বাষ্প-চালিত নৌকা আবিষ্কার করেন। এটি ঘন্টায় চারমাইল বেগে চলত। ক্রমে বাষ্পীয় পোত আবিষ্কার হল। আগেকার দিনের পালতোলা জাহাজ অপেক্ষা বাষ্পীয় শক্তিচালিত জাহাজ অনেক বেশি কার্যকর ছিল। ‘সাভানা’ নামে প্রথম বাষ্পীয় জাহাজ তৈরি করা হল। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে এই জাহাজ প্রথম আটলান্টিক মহাসমুদ্রে পাড়ি দেয়। বাষ্পচালিত জাহাজ আবিষ্কারের ফলে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পণ্য চলাচল দ্রুত ও নিরাপদ হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।

রেলপথ

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে জর্জ স্টিফেন্সন বাষ্পচালিত দ্রুতগতির রেল-ইঞ্জিন তৈরি করলে পরিবহণের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যায়। এই ইঞ্জিন লোহার পাতের ওপর আটটি কামরা নিয়ে ঘন্টায় ৩০ মাইল বেগে দৌড়াতে পারত। লিভারপুল থেকে ম্যাঞ্চেস্টারের মধ্যে প্রথম রেলপথ নির্মিত হয়। রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং কারখানায় তৈরি ভোগ্য পণ্যাদি ঐসব অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া সহজতর হয়। ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন রেলপথ নির্মাণের ওপর প্রবল গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৮৫০-এ ফ্রান্সে রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৩০০ কিলোমিটার। ১৮৭০-এ তা বেড়ে হয় ১৭,৫০০ কিলোমিটার। জার্মান শাসকরা রেলপথ নির্মাণে প্রবল উৎসাহী ছিলেন। ১৮৩৫-এ প্রথম রেলপথ নির্মিত হয় ব্যাভোরিয়াতে। ১৮৪৮-এ প্রাশিয়ায় ১৫০০ মাইল রেলপথ নির্মিত হয়েছিল। ১৮৭৩-এ প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার রেলপথ জার্মানির বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চল ও শহরগুলিকে ঐক্যবন্ধ করে। ডেভিড টমসন বলেন যে, ‘জেলভেরাইন’ নামক শুল্ক সঙ্ঘ যেমন জার্মানির কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা দূর করেছিল, তেমনি রেলপথ প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে জার্মানির সংহতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করেছিল। ভারতে প্রথম রেলপথ নির্মিত হয় ১৮৫৩ সালে।

সুয়েজ খাল

১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ খালের উন্মোচন শিল্পবিপ্লব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক অগ্রগতি। আগে ইউরোপ থেকে এশিয়া বা পূর্ব আফ্রিকায় যেতে হলে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে অনেক পথ ঘুরে যেতে হত। মিশর ও সিনাই উপদ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মিশরীয় ভূখন্ডে এই খাল খনন করে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে জুড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব অবিশ্বাস্যভাবে কমে আসে এবং দুপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সহজতর হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এই খননকার্য শুরু হয় এবং দীর্ঘ দশ বছর পর ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তা সম্পন্ন হয়।

টেলিগ্রাফ

টেলিগ্রাফের ব্যবহার যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি আনে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বহু দূরবর্তী স্থানে অতি দ্রুত খবর পাঠানো যেত। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে স্যামুয়েল সোমেরিং সর্বপ্রথম টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেন। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা উন্নততর হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যই নয়- ঔপনিবেশিক শাসকরা এই ব্যবস্থার সাহায্য নিতে থাকে এবং কালক্রমে এটি সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে বাণিজ্যিক ও ভারতের প্রশাসনিক দিক থেকে নানা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। পূর্বে গভর্নর জেনারেল ভারত-সংক্রান্ত সব বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতেন (কারণ ইংল্যান্ডে খবর পাঠিয়ে, সেখান থেকে উত্তর আসতে বহু সময় লেগে যেত)। টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা শুরু হলে গভর্নর জেনারেল সব সিদ্ধান্তের জন্য ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী ‘ভারত সচিব’- এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ভারতীয় শাসননীতিতে ব্রিটিশ শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্ক মালিকদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান হয়ে পড়ে।

Leave a Comment