রুশ বিপ্লবের রূপরেখা

রুশ বিপ্লবের রূপরেখা
রুশ বিপ্লবের রূপরেখা

জারের পদত্যাগ

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মার্চ (পুরানো বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ২৩শে ফেব্রুয়ারি) পেট্রোগ্রাড শহরের প্রায় ৮০-৯০ হাজার শ্রমিক বলশেভিকদের নেতৃত্বে খাদ্যের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করে। তাদের কণ্ঠে স্লোগান ছিল- ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’, ‘যুদ্ধ নিপাত যাক’। ১১ই মার্চ জারের সেনাদলের সঙ্গে ধর্মঘটি শ্রমিকদের পথযুদ্ধ শুরু হয়। ১২ই মার্চ জারের পাড়লোভস্কি রেজিমেন্ট ও ভলিনস্কি রেজিমেন্ট বিদ্রোহীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। বিদ্রোহীরা এবার অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে এবং থানা ও বিচারালয়গুলিতে অগ্নিসংযোগ করে। জারের মন্ত্রী ও সেনাপতিরা বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি হয়। ১২ই মার্চ সন্ধ্যার মধ্যে রাজধানী পেট্রোগ্রাড বিপ্লবীদের দখলে চলে যায়। বিপ্লবী শ্রমিক ও বিদ্রোহে যোগদানকারী সেনাদের নিয়ে গঠিত হয় পেট্রোগ্রাড ‘সোভিয়েত’। রাশিয়ার বিভিন্ন শহর ও গ্রামে অনুরূপ ‘সোভিয়েত’ গড়ে উঠতে থাকে। ১৩ই মার্চ (২৮শে ফেব্রুয়ারি) জার দ্বিতীয় নিকোলাস পদত্যাগে বাধ্য হন। এইভাবে দীর্ঘ তিনশো বছরের রোমানভ বংশের শাসনের অবসান ঘটে। ‘ডুমা’-র বুর্জোয়া নেতৃবৃন্দ প্রিন্স জর্জ লুভড্ (Prince Luvov)-এর নেতৃত্বে রাশিয়ায় একটি অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠন করে। এইভাবে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ‘মার্চ বিপ্লব’ বা ‘বিপ্লবের প্রথম পর্যায়’ সমাপ্ত হয়।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে রাশিয়ায় যে বিপ্লব সংঘটিত হয়, তার দ্বারা জারতন্ত্রের অবসান ঘটলেও জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯১৭-র নভেম্বর মাসে সংঘটিত ‘নভেম্বর বিপ্লব’ বা ‘বলশেভিক বিপ্লব’-এর দ্বারাই প্রকৃতপক্ষে জনগণের হাতে শাসন-ক্ষমতা আসে।

অস্থায়ী সরকার

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস থেকে রাশিয়ায় কার্যত দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চলতে থাকে। সম্পত্তির ভিত্তিতে প্রদত্ত ভোটাধিকারের দ্বারা নির্বাচিত ‘ডুমা’-র বুর্জোয়া সদস্যরা রাশিয়াতে একটি অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। বলশেভিকরা এই সরকারকে মানত না। তাদের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের নিয়ে ‘সোভিয়েত’ বা পরিষদ গড়ে ওঠে। বলশেভিকদের দাবি ছিল, সব ক্ষমতা এই ‘সোভিয়েত’-গুলিকে হস্তান্তর করতে হবে- সাধারণ মানুষদের নিয়ে গঠিত ‘সোভিয়েত’গুলিই জাতির প্রকৃত প্রতিনিধি। অপরপক্ষে, প্রজাতন্ত্রী সরকার বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্ব করত। অস্থায়ী সরকার জনগণের কোনো আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে না পারায় শীঘ্রই জনপ্রিয়তা হারায়। (ক) সেনাদল আশা করেছিল যে, যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং দেশে শান্তি স্থাপিত হবে। (খ) কৃষকেরা আশা করেছিল যে, আমূল ভূমিসংস্কার হবে এবং এর দ্বারা ‘কুলাক’ প্রথার অবসান ঘটিয়ে তাদের মধ্যে ভূমিবন্টন করা হবে। (গ) শ্রমিকরা আশা করেছিল যে, তাদের মজুরি বৃদ্ধি পাবে এবং কাজের সময় আট ঘণ্টা স্থির হবে। (ঘ) অ-বুশ জাতিরা আশা করেছিল যে, তাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকৃত হবে। বলা বাহুল্য, কারও কোনো আশাই পূরণ হয়নি। এই অবস্থায় কৃষকেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারা জমিদারদের জমিগুলি দখল করে, খামারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করে এবং জমিদারদের হত্যা করতে থাকে। শ্রমিকরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর ফলে রাশিয়ায় এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এপ্রিল থিসিস

এই অবস্থায় বলশেভিক নেতা লেনিন সুইজারল্যান্ডের নির্বাসন থেকে রাশিয়ায় ফিরে এসে (১৬ই এপ্রিল, ১৯১৭ খ্রিঃ) বলশেভিক কর্মীদের সামনে বিখ্যাত এপ্রিল থিসিস’ বা ‘এপ্রিল মতবাদ’ নামে এক কর্মধারা তুলে ধরেন। মনে রেখো: বলশেভিক কর্মীদের তিনি বলেন যে, বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রী সরকারের হাত থেকে এক্ষুনি ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। তিনি দাবি করেন যে, “সব ক্ষমতা সোভিয়েতগুলির হাতে দিতে হবে।” তিনি শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক ও সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। তিনি ঘোষণা করেন যে, বলশেভিকরা ক্ষমতা পেলে সৈনিকরা পাবে শান্তি, কৃষকরা জমি ও শ্রমিকরা বুটি। এই ‘শান্তি, জমি ও রুটি’র স্লোগান তাদের জনপ্রিয়তা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি করে।

কেরেনেস্কি সরকার

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই বহুসংখ্যক সৈনিক ও অসংখ্য শ্রমিক পেট্রোগ্রাডের রাস্তায় সমবেত হয়ে ‘সব ক্ষমতা সোভিয়েতগুলিকে দেবার ‘দাবি তোলে। প্রজাতন্ত্রী সরকার এই শান্তিপূর্ণ জমায়েতের ওপর গুলি চালায়। এই অবস্থায় ‘মেনশেভিক ‘দলের সেনাপতি আলেকজান্ডার কেরেনস্কি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই সরকারও অচিরেই জনসমর্থন হারায়। জনসাধারণের আপত্তি উপেক্ষা করে এই সরকার জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। যুদ্ধের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সংকট তীব্রতর হয়। অবস্থা মেনশেভিকদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।

বলশেভিকদের ক্ষমতা দখল

এই পরিস্থিতিতে ৭ই নভেম্বর লেনিনের নির্দেশে ট্রটস্কি-র নেতৃত্বে ‘রেড গার্ড’ বা ‘লাল ফৌজ’ নামক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রাজধানী পেট্রোগ্রাড-এর সরকারি অফিস, ব্যাংক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেলস্টেশন দখল করে। কেরেনস্কি পলায়ন করেন। বলশেভিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।

Leave a Comment