লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো
লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবাদের বিকাশ আলোচনা করো

সূচনা

পৃথিবীর যে-কোনো দেশে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিকাশের সঙ্গে সেই দেশের দেশাত্মবোধক বা জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেশাত্মবোধক সাহিত্যের বিকাশ ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কাব্য, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ-সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রেই সেদিন মূল সুর ছিল দেশপ্রেম। ভারতীয় চিত্রকলাতেও সেদিন স্বাদেশিকতার ছোঁয়া লেগেছিল। ভারতীয় জাতীয় জাগরণে এইসব গ্রন্থ এবং চিত্রকলার গুরুত্ব অপরিসীম।

‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২ খ্রিঃ)

সূচনা: ভারতীয় জাতীয় জাগরণ ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ‘সাহিত্য সম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস এক অতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। উনিশ শতকের শেষ পাদে জাতীয় জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে প্রকাশিত হয়ে এই মহাগ্রন্থটি বাঙালি তথা ভারতবাসীকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মহত্তর আদর্শে দীক্ষিত করে ভারত ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। আধুনিক ভারতে লিখিত আর কোনো গ্রন্থ সর্বভারতীয় রাজনীতি ও জীবনবাদের ওপর এমন গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল বলে জানা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ভাবোদ্দীপক ও প্রেরণাদাত্রী অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, কিন্তু দেশপ্রেমের উদ্দাম আবেগে উদ্বেলিত করে সমগ্র জাতিকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে, এমন গ্রন্থের সংখ্যা খুবই কম। ‘আনন্দমঠ’ হল এই শ্রেণিরই গ্রন্থ এবং ভাবসম্পদ, চিন্তার ঐশ্বর্য ও গভীরতা এবং বুদ্ধিরদীপ্তিতে ‘আনন্দমঠ’ ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম অনুপ্রেরণা বুশোর ‘সোশ্যাল কনট্রাক্ট’-এর সমতুল্য।

বিষয়বস্তু: ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জনজীবনের কোলাহল থেকে দূরে এক নিভৃত স্থানে একটি মঠ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই মঠে বসবাসকারী ত্যাগী সন্ন্যাসীরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। তাঁদের লক্ষ্য আত্মমুক্তি নয়-দেশমাতৃকার মুক্তি। এই উপন্যাসে তাঁদের মুক্তি সংগ্রামের কাহিনিই বিবৃত হয়েছে। এই কাহিনির মধ্য দিয়ে ‘সাহিত্য সম্রাট’ দেশপ্রেমের আদর্শ ও দেশপ্রেমিকদের নীতিবোধকে মুক্তিকামী জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, বঙ্কিম-প্রদর্শিত কর্মপদ্ধতি ও ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মৃত্যুভয়হীন চিত্তে দেশপ্রেমিকরা মাতৃমুক্তিযজ্ঞে নিয়োজিত হতেন। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হত ‘আনন্দমঠ’-এর অমোঘ বাণী ‘বন্দেমাতরম’। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “আর কোনো বাংলা বই বা অন্য কোনো ভাষায় লেখা কোনো বই বাঙালি যুবকদের এত গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেনি।”

গ্রন্থের আদর্শ: বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’-এর মাধ্যমে দেশপ্রেমিকদের সামনে কয়েকটি নতুন বিশ্বাস ও আদর্শ তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, দেশ নিছক একটি জড় বস্তু নয়-দেশের মধ্যে চিন্ময়ী সত্তা আছে। দেশ আমাদের মা। মঠাধীশ সত্যানন্দ বলেছেন- “আমরা অন্য মা মানি না-জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী। আমরা বলি, জন্মভূমিই জননী, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই, আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা, মলয়জ সমীরণ শীতলা শস্যশামলা…” মা। দেশ আমাদের ঈশ্বর। দেশপ্রেমই ধর্ম এবং ধর্মই দেশপ্রেম। এই ধর্মের নাম ‘সন্তান ধর্ম’। তিনি সন্ন্যাসের এক নতুন আদর্শ তুলে ধরলেন। এতদিন ভারতবাসী ঈশ্বরের সন্ধানে সংসার ত্যাগ করে বনে-জঙ্গলে গিয়ে আত্মমুক্তির কথা চিন্তা করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র নতুন সন্ন্যাসী সম্প্রদায় সৃষ্টি করে বললেন যে, সন্ন্যাসীর লক্ষ্য মানুষের মুক্তি, দেশের মুক্তি, দেশহিতৈষণা। । আবেদন-নিবেদন নয়-আত্মবিশ্বাস, ক্ষাত্রশক্তি ও আত্মদানের মাধ্যমে দেশমাতৃকার মুক্তি অর্জিত হবে। দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে নারী সমাজকেও সঙ্গে চাই-নারী জাগরণ ছাড়া দেশের মুক্তি সম্ভব নয়। জনজাগরণ চাই। চাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সমগ্র জাতি। জাতি জাগলে দেশ জাগবে-দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হবে। তাই আপামর জনসাধারণের জাগরণ চাই। দেশপ্রেমিকের নীতিবোধ থাকবে-তিনি নিষ্কামভাবে কাজ করবেন। নীতিহীন হলে তাঁর সকল প্রয়াস, সকল ত্যাগ ব্যর্থ হবে। গ্রন্থশেষে মহাপুরুষ সত্যানন্দকে বলছেন- “পাপের ফল কখনও পবিত্র হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না।”-এ এক চিরন্তন সত্য।

উপসংহার: ‘আনন্দমঠ’-এর আদর্শ যুগ যুগ ধরে পরাধীন জাতির মনে অনুপ্রেরণা যোগাবে। এই গ্রন্থ জাতীয়তার বেদ, বাইবেল ও গীতা। এর মূল কথাই হল দেশপ্রেম, বিদ্রোহ, বিপ্লব ও স্বাধীনতা।

‘বর্তমান ভারত’ (১৯০৫ খ্রিঃ)

সূচনা: স্বামী বিবেকানন্দ রচিত ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি আকারে ক্ষুদ্র-স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের মতোই সংক্ষিপ্ত এবং তাঁর জীবনের মতোই শক্তি ও সম্ভাবনায় স্পন্দিত। এই গ্রন্থে স্বামীজী ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস মন্থন করে ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে সংহত আকারে প্রকাশ করেছেন। বাংলা ভাষায় এটিই একমাত্র গ্রন্থ, যা বিশ্ব ইতিহাসের তথ্য নয়, বিশ্ব-ইতিহাসের ভাষ্য। স্বামী সারদানন্দ যথার্থভাবেই বলেছেন যে, “স্বামী বিবেকানন্দের সর্বতোমুখী প্রতিভা-প্রসূত ‘বর্তমান ভারত’ বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ।”

প্রকাশ: ‘বর্তমান ভারত’ ধারাবাহিকভাবে প্রথম প্রকাশিত হয় পাক্ষিক ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় (১৩০৫-০৭)। পরে স্বামী সারদানন্দের ভূমিকা-সংবলিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় (১৩১২)। গ্রন্থটির নাম ‘বর্তমান ভারত’ হলেও এর অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে ভারতের দশ হাজার বছরের অতীত ইতিহাসের সমীক্ষা। এর প্রেক্ষাপটেই তিনি তাঁর সমকালীন ভারতকে দেখেছেন এবং সে সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।

ইতিহাসের বিশ্লেষণঃ
এই গ্রন্থে ভারতবর্ষের ইতিহাস বিশ্লেষণে তিনি যে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। ভারত- ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে, ইতিহাস শ্রেণি-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। স্বামীজির মতে, পৃথিবীর সর্বত্রই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চারটি বর্ণ পর্যায়ক্রমে পৃথিবী শাসন করবে। প্রথম দুটি বর্ণের শাসনকাল শেষ হয়ে গেছে। তৃতীয় বর্ণ বৈশ্যের শাসনকালও সমাপ্তির মুখে। চতুর্থ বর্ণ শূদ্রের শাসনকাল অবশ্যম্ভাবী এবং তা ঐতিহাসিক সত্য। ভারত-ইতিহাসের প্রথম পর্বে ছিল পুরোহিত শাসন। মস্তিষ্ক-প্রসূত জ্ঞানে বলীয়ান পুরোহিতরা রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করত। নৃপতিরাও নানাভাবে খুশি করতেন তাঁদের। এই পর্বে বৈশ্য সম্প্রদায় ও সাধারণ প্রজাদের কোনো গুরুত্ব ছিল না। এর পর হল ক্ষত্রিয় শাসন। বৌদ্ধযুগ থেকে মোগল যুগ পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি। বৈদিক যুগ থেকেই পুরোহিত শক্তির সঙ্গে রাজশক্তির বিবাদ চলছিল। এরপর বৌদ্ধ ও জৈন যুগ যখন এল, তখন ক্ষত্রিয়শক্তি ব্রাহ্মণশক্তিকে পরাভূত করল। আবির্ভাব হল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, রাজর্ষি অশোক প্রমুখ একচ্ছত্র সম্রাটদের। বৌদ্ধযুগে নৃপতি ও পুরোহিতের অবস্থান উল্টো ছিল। নৃপতি ওপরে উঠলেন, ব্রাহ্মণ নীচে নামলেন। বৌদ্ধযুগের শেষে আধুনিক হিন্দুধর্মের অভ্যুদয়কালে বৌদ্ধ-বিরোধিতায় ক্ষত্রিয়দের সাহায্য করেছিল ব্রাহ্মণশক্তি। এ যুগও ক্ষত্রিয় প্রাধান্যের যুগ। এরপর এল মুসলিম যুগ। এ যুগে পুরোহিত শক্তির সমূল বিনাশ হল, কারণ ‘মুসলিম রাজত্বে রাজাই প্রধান পুরোহিত’। ভারতের মোগল রাজশক্তিকে পরাভূত করে ইংরেজশক্তি ভারতে প্রতিষ্ঠিত হল। ইংরেজ বৈশ্যশক্তি-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন আবর্তিত। বিদ্যা, অস্ত্র ও অর্থ-এই তিন শক্তির সাহায্যে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণ আধিপত্যে বিদ্যার বিকাশ হয়, ক্ষত্রিয় আধিপত্যে হয় সভ্যতার স্যার এবং বৈশ্য আধিপত্যে ঐশ্বর্য্যের প্রাচুর্য। যাদের শারীরিক পরিশ্রমে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য, ক্ষত্রিয়ের শক্তি এবং বৈশ্যের সম্পদ, সেই শূদ্রের অবস্থান কোথায়? তারা তো ‘ভারবাহী পশু’, ‘চলমান শ্মশান’। স্বামীজি দেখিয়েছেন যে, ভারতে শূদ্রদের অবস্থা শোচনীয় হলেও, পৃথিবীর অন্যান্য অংশে তারা জেগে উঠছে। স্বামীজির বিশ্বাস-এর পরেই পৃথিবীতে শূদ্র যুগ আসছে।

স্বদেশমন্ত্র :
এরপর স্বামীজী ভারতের ইংরেজ শাসনের দোষ-গুণ বিচার করে বলেছেন যে, ইংরেজ আগমনে ভারতের আর্থিক উন্নতি হয়েছে এবং বিদেশি ভাবরাশি ভারতে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে বহু কল্যাণকর ভাব থাকলেও অকল্যাণকর ভাবও অনেক আছে। স্বামীজীর মতে, ভারতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত সংস্পর্শের সব চেয়ে বিষময় ফল হল ভারতবাসীর নির্বিচার পাশ্চাত্য অনুসরণ। গ্রন্থের উপসংহারে স্বামীজী তাই দেশবাসীকে ‘স্বদেশমন্ত্র’ উপহার দিচ্ছেন। বলছেন- ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বরণ করতে। অনবদ্য এই ‘স্বদেশমন্ত্রে’ তাঁর ভারতপ্রেম প্রকট হয়ে উঠেছে, যা প্রত্যেক ভারতবাসীর অনুসরণ করা কাম্য। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন-

“হে ভারত, এই পরাণুবাদ, পরাণুকরণ, পরামুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?” পরাণুকরণ নয়, দাসসুলভ দুর্বলতা নয়- নিজেকে স্বাধীনচেতা হতে হবে। “এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে?” স্বাধীনতা বীরের জন্য-কাপুরুষদের জন্য নয়। ভারতবাসীর প্রতি স্বামীজীর নির্দেশ কাপুরুষতা ত্যাগ করে বীর হও, কারণ ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’- বীররাই বসুন্ধরা ভোগ করে। “হে ভারত, ভুলিও না-তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলিও না-তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না- তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের-নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে-তুমি জন্ম হইতেই ‘মায়ের’ জন্য বলিপ্রদত্ত।” ভারতবাসীকে পাশ্চাত্যের মোহে অন্ধ হলে চলবে না। ভারতীয় নারীরা সীতা, সাবিত্রী ও দময়ন্তীর আদর্শ অনুসরণ করবে। পুরুষদের আদর্শ কে? স্বামীজী বললেন- “ভুলিও না- তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর।” স্বদেশবাসীকে তিনি বলছেন যে, আমাদের কোনো কিছুই ব্যক্তিগত সুখের জন্য নয়-আমরা সকলেই “জন্ম হইতেই ‘মায়ের’ জন্য বলিপ্রদত্ত।” স্বামীজী বলছেন যে, নীচজাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর আমাদের রক্ত, আমাদের ভাই। আমরা ভারতবাসী, ভারতবাসী আমাদের ভাই। • এরপরের বক্তব্যে স্বামীজির স্বদেশপ্রেম প্রবলভাবে উৎসারিত হয়ে উঠেছে। দেশ ও দেশবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে অনবদ্য ভাষায় তিনি বলছেন “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই-ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।” দেশ, দেশবাসী ও দেশের মাটির সঙ্গে এমন একাত্ম হয়ে ওঠার বিবরণ আর কোথায় পাওয়া যাবে। একেবারে শেষে দেবতার কাছে প্রার্থনা-দিনরাত প্রার্থনা- আমাদের মনুষ্যত্ব চাই-মানবিক গুণাবলী চাই। চাই আত্মশক্তি, আত্মবল-তাই কাপুরুষতা দূর করতে হবে। আমাদের মানুষ হতে হবে। স্বামীজির স্বদেশপ্রেম পূর্ণতা পেয়েছে এই ‘স্বদেশমন্ত্রে’।

গোরা’ (১৯০৯ খ্রিঃ)

সূচনাঃ বাংলা উপন্যাসে ভারত-চিন্তা ও জাতীয়তাবোধের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গোরা’। ‘গোরা’ একটি উপন্যাস। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। তখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দেশের চিত্তকে আলোড়িত করেছে। তাই রবীন্দ্রনাথকে কোনো ঐতিহাসিক বা রোমান্টিক কাহিনির আশ্রয় নিতে হয়নি বা পাঠককে আকৃষ্ট করবার জন্য কোনো বীরকেও আনতে হয়নি।

ভারতের সত্য পরিচয়: রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ আমাদের সবার পরিচিত। সকল ত্রুটি, দুর্বলতা, কুসংস্কার, দারিদ্র ও অজ্ঞতা মিলিয়ে সেই ভারতবর্ষ। এটাই সব নয়। সত্যনিষ্ঠা, ত্যাগ, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও মিলন, মানবতা, বিশ্বজনীন ভালবাসা এবং সর্বভূতে প্রীতি- এটাই ভারতবর্ষ, এটাই ভারতবর্ষের সত্যমূর্তি। উপন্যাসের নায়ক গোরা ভারতবর্ষের সত্য মূর্তি উপলব্ধি করার জন্য এবং সকলকে তা উপলব্ধি করাবার জন্য ব্যাকুল। সে বিনয়কে বলছে- “সত্যের ছবি স্পষ্ট দেখতে না পেলে লোকে আত্মসমর্পণ করবে কোন্ উপছায়ার কাছে? ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মূর্তিটা সবার কাছে তুলে ধরো-লোকে তা হলে পাগল হয়ে যাবে।… প্রাণ দেবার জন্য ঠেলাঠেলি পড়ে যাবে।”

গোরা-র দেশপ্রেম: কে এই গোরা? সে নিষ্ঠাবান ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ কুরুদয়াল ও আনন্দময়ীর সন্তান। সে নিষ্ঠাবান স্বদেশি, নিষ্ঠাবান ভারতীয়, নিষ্ঠাবান হিন্দু, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক এবং নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মী। ভারতের সীমাহীন দুঃখ-দারিদ্র্য, অভাব-অনটন ও অজস্র ত্রুটি সত্ত্বেও ভারতবর্ষের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভালোবাসা, সীমাহীন শ্রদ্ধা। এ কারণেই পথে-ঘাটে কোনো ইংরেজের সঙ্গে মারামারি করতে পারলেই সে তাঁর জীবন ধন্য বলে মনে করত। ভারতবর্ষের নানা প্রকাশ ও নানা বিচিত্র চেষ্টার মধ্যে সে এক গভীর ও বৃহৎ ঐক্য প্রত্যক্ষ করেছে। ভারতের মূঢ়তম মানুষটিও তার আপনজন। তার মতে এই মূঢ় মানুষগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে চিরন্তন ভারতবর্ষ।

গোরার আদর্শ: সুচরিতা জানতে চাইল যে, গোরা বিশেষ কোনো দলভুক্ত কিনা। তখন সে নিঃসঙ্কোচে জানাল যে, সে হিন্দু। সে নিজেই বলছে যে, হিন্দু কোনো দল নয়-হিন্দু একটা জাতি। এই জাতি এত বৃহৎ যে, এই জাতির জাতিত্ব কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যায় না। হিন্দুধর্ম মায়ের মতো নানা ভাবের ও নানা মতের মানুষকে কোল দেবার চেষ্টা করেছে। একমাত্র হিন্দুধর্মই জগতে সব মানুষকে মানুষ বলে স্বীকার করেছে। হিন্দুধর্ম মূঢ়কেও মানে, জ্ঞানীকেও মানে এবং কেবলমাত্র জ্ঞানের কোনো বিশেষ রূপকে মানে না-জ্ঞানের সকল প্রকার বিকাশকেই মানে।

গোরার উত্তরণ: গোরার কাছে এই হল হিন্দুধর্মের সার্বজনীন রূপ। হিন্দুদের ঔদার্য নিয়ে সে যখন গৌরব বোধ করছে, তখন সে বিন্দুমাত্র আভাসও পায়নি যে, অচিরেই তার জন্মপরিচয় উদ্ঘাটিত হবে এবং সেই মুহূর্তেই ভারতবর্ষের সব মন্দিরের দ্বার তার কাছে বুদ্ধ হয়ে যাবে। এত বড়ো আঘাতে গোরা ভেঙে পড়েনি বা অভিমানে দূরে সরে যায়নি। এতদিন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যে গৌরববোধ তার চারদিকে যে বেষ্টনী সৃষ্টি করে রেখেছিল, তা থেকে মুক্তি পেয়ে সে ভারতের অন্তরাত্মার একেবারে অন্তরতম হয়ে ওঠার সুযোগ পেল। সে ব্রাহ্মণ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিল-জানল যে তার সে পরিচয় মিথ্যা। জন্মসূত্রে সে খ্রিস্টান। সিপাহি বিদ্রোহের কালে এক পলায়নপর আইরিশ নারীর গর্ভে তাঁর জন্ম। সকল ধর্ম ও সংস্কারের বন্ধন থেকে অকস্মাৎ মুক্তি পেয়ে গোরা বলছে- “আজ আমি ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান কোনো সমাজের বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।”

গোরার ভারতবর্ষ: এমন ভারতবর্ষ শুধুই কল্পনা নয়। সেই ভারতবর্ষের প্রতীক আনন্দময়ী- গোরার পালিকা মা। আত্মপরিচয় জানার পর আনন্দময়ীকে প্রণাম করে গোরা বলল, “মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই- শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ।” গোরা আনন্দময়ীকে শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত, মা বলে ডাকত, কিন্তু আগে কখনও তাঁকে ভারতবর্ষের প্রতীক হিসেবে দেখেনি। এই দেখাটা সহজ হল যখন সে জানল যে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ-গৃহিনী হয়েও আনন্দময়ী অনাথ খ্রিস্টান শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়ে নিজ সন্তানের মতোই মানুষ করেছেন এবং মাতৃস্নেহের অকৃপণ দানে গোরার জীবন ধন্য করেছেন।

প্রকৃত ভারত: আনন্দময়ীর মতো ভারতবর্ষেরও কোনো জাতি নেই-জাতি থাকলে এত জাতিকে সে আশ্রয় দিত কী করে। ভারতবর্ষ কাউকে ঘৃণা করে না। ঘৃণা করলে, তার বুকের ওপর বসে এত ঘৃণ্য আচরণ কী করে সম্ভব হত। এই অপরিসীম সহনশীলতা ও সুগভীর স্নেহ দিয়ে ভারতবর্ষ বহু শতাব্দী ধরে কত বিচিত্র নরনারীকে বেঁধে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের যে ভারতবর্ষ সেখানে সহস্র বৈচিত্র্য থাকতে পারে, কিন্তু সংকীর্ণতার স্থান নেই সেখানে। সংকীর্ণতার গন্ডি যারা ভাঙতে পেরেছে তারাই কবির আদর্শ ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব লাভ করে ধন্য হয়েছে। গোরা, সুচরিতা, বিনয়, ললিতা এরা সকলেই সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠে স্থান পেয়েছে ভারতবর্ষের অন্তরে।

ভারতমাতা’ (১৯০৫ খ্রিঃ)

কেবলমাত্র কাব্য-নাটক-সংগীত বা উপন্যাসেই নয়-চিত্র ও শিল্পকলাতেও সেদিন দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধের সুর। ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সেই উন্মাদনার দিনে সারা বাংলা সেদিন দেশবন্দনা বা মাতৃবন্দনায় উদ্বেল হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কন করলেন বঙ্গমাতা-র ছবি। পরে ভগিনী নিবেদিতা এর নাম দেন ‘ভারতমাতা’। এক কথায়, অসাধারণ এই ছবিটি। গৈরিকবস্ত্রে মন্ডিতা এই মাতৃমূর্তি চতুর্ভুজা। তাঁর চার হাতের এক একটিতে ধরা আছে পুস্তক, ধানের গোছা, শ্বেতবস্ত্র এবং পুষ্পমালা, অর্থাৎ সন্তানের প্রতি মায়ের দান-অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা।

স্বদেশি বাংলায় এই ছবি নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়। অবনীন্দ্রনাথের’ ঘরোয়া’ গ্রন্থে এর বিবরণ আছে। সেদিন এই ছবি নিয়ে দেশে যথেষ্ট হৈ চৈ পড়ে যায়। এই ছবি ‘নব-জাতীয়তাবাদের’ প্রতীকে পরিণত হয়। দেশবাসী মাতৃমূর্তি পায়। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু এই ছবি আরও বড়ো করে আঁকিয়ে তাঁর বাড়িতে টাঙিয়ে রাখেন। জাপানি শিল্পী ওকাকুরা এই ছবি নিয়ে বড়ো আকারের একটি পতাকা তৈরি করলেন। এই পতাকা কাঁধে নিয়ে তখন শোভাযাত্রা বেরোত। ছবিটি দেখে ভগিনী নিবেদিতা এতই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন যে, তিনি মন্তব্য করেন যে, হাতে অর্থ থাকলে নবভারতের প্রতীক এই ছবিটি ছাপিয়ে কেদার-বদরির আশ্রম থেকে কন্যা কুমারিকা পর্যন্ত ভারতের প্রতিটি কৃষকের ঘরে একটি করে উপহার দিতেন। এ কথা মানতেই হবে যে, ইতিহাসে এর চেয়ে বড়ো তারিফ বোধহয় আর কোনো চিত্রকরের ভাগ্যে জোটেনি। অন্যদিকে ব্রাহ্ম। সমাজের অনেকেই কিন্তু এই মূর্তিপুজার বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হন। মুসলিম সমাজও কিন্তু বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। এ সত্ত্বেও বলতে হয় যে, অবনীন্দ্রনাথ অঙ্কিত এ চিত্র দেশে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। মূল চিত্রটি বর্তমানে ‘রবীন্দ্র ভারতী সমিতি’-র সংগ্রহে আছে।

গগনেন্দ্র ঠাকুরের (১৮৬৭-১৯৮৮ খ্রিঃ) ব্যঙ্গচিত্র

বাংলার চিত্রশিল্পের ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ গগনেন্দ্রনাথ এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর শিল্পীজীবন নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কেটেছে। ব্যঙ্গচিত্রী হিসেবেও তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’-তে তাঁর-আঁকা কার্টুনগুলি ছাপা হত। তাঁর অঙ্কিত ব্যঙ্গ-চিত্রাবলীর অনেকগুলিই ‘বিরূপ বজ্র’, ‘অদ্ভুতলোক’, ‘নবহুল্লোড়’ প্রভৃতি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর ‘বিরূপ বজ্র’ গ্রন্থে ১৯০৬ থেকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার কার্টুন অঙ্কিত হয়েছে। বিষয়বস্তু হল বাঙালি সমাজের ইংরেজ-প্রীতি, বাঙালি চরিত্রের নানা দিক এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ, অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভূমিকা (শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য- দেশবন্ধু কর্তৃক গ্রন্থে অগ্নিসংযোগ, ছাত্রদের ‘গোলামখানা’ ত্যাগের আহ্বান) প্রভৃতি কার্টুনগুলি ইতিহাসের অমূল্য উপাদান।

Leave a Comment