![]() |
শিল্পবিপ্লবের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ফলাফল কী ছিল? |
ভূমিকা
অর্থনৈতিক ফলাফল
[১] উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার : শিল্পবিপ্লবের ফলে অল্প সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে দ্রব্য প্রস্তুত হওয়ায় ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রভূত প্রসার ও অর্থ সমাগম হয়। সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড সমগ্র বিশ্বের কারখানায় (Workshop of world) পরিণত হয়।
[২] শিল্পাশ্রয়ী পুঁজিতন্ত্রের উদ্ভব: শিল্পবিপ্লবের ফলে বাণিজ্যিক মূলধন শিল্পাশ্রয়ী ধনতন্ত্র বা পুঁজিতন্ত্রে (Industrial Capitalism) পরিণত হয়। পুঁজিপতি মালিকেরা শিল্পোৎপাদনে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকে এবং কালক্রমে যৌথ বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানে (Joint stock company) বহু ধনী ব্যক্তির মূলধন নিয়োজিত হয়।
[৩] মধ্যযুগীয় উৎপাদন ব্যবস্থার অবসান: ধনতন্ত্রের অভ্যুদয়ের ফলে মধ্যযুগের কুটিরশিল্প, কারিগর শ্রেণি ও সমবায় সংঘ (guilds) গুলির অবসান ঘটে এবং ধনতান্ত্রিক শিল্প-ব্যবস্থা অর্থনীতির ভিত্তিতে পরিণত হয়।
[৪] শ্রমবিভাজন নীতির অধিকতর প্রয়োগ: শিল্পবিপ্লবের ফলে বৃহৎ কারখানাকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হয়। ফলে কারখানায় কোনো একটি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়াটি একজন শ্রমিক পরিচালনা না করে অনেক শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে, যা শ্রমবিভাজন নামে পরিচিত। ফলে শ্রমিকরা ক্রমশ সংশ্লিষ্ট উৎপাদনক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষ হয়ে ওঠে।
[৫] ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঔপনিবেশিক : শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পোৎপাদনে অগ্রণী দেশগুলি তাদের দেশের কলকারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী বিক্রির জন্য বিদেশের বিশেষত এশিয়া ও আফ্রিকার বাজার দখলে অগ্রসর হয়। এভাবে শুরু হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা।
সামাজিক ফলাফল
[১] নগরকেন্দ্রিক সমাজজীবন: শিল্পবিপ্লবের ফলে অর্থনৈতিক জীবনে কৃষিকার্যের গুরুত্ব কমে যায় এবং কৃষিজীবীদের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরের কারখানায় মজুরের জীবন গ্রহণ করে। এইভাবে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কারখানাগুলিকে কেন্দ্র করে বড়ো বড়ো শহর গড়ে ওঠে এবং নগরকেন্দ্রিক সমাজজীবনের সৃষ্টি হয়।
[২] জনসংখ্যা বৃদ্ধি: শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপে ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমে ইউরোপে জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে বারো কোটি, তা একশো বছরে আঠারো কোটি সত্তর লক্ষে পরিণত হয়। তবে ইংল্যান্ডে জনসংখ্যার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ইউরোপের সর্বত্র জনসংখ্যার হার সমভাবে বৃদ্ধি পায়নি, কারণ যে সকল অঞ্চলে শিল্পের প্রসার ঘটেছিল, সেখানেই দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
[৩] সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে পরিবর্তন: নতুন শহরগুলি গড়ে উঠবার ফলে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে। শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে দুটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়, মূলধনি শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণি।
[৪] শিল্পপতি ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে মানসিক ব্যবধান : শিল্পবিপ্লব থেকে উদ্ভুত হলেও শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল এবং ফলে সূচনা থেকেই শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক ছিল অবিশ্বাস ও সন্দেহে ভরা। একদিকে মালিকেরা বিলাসব্যসনে দিনযাপন করতেন, অন্যদিকে শ্রমিকের অবস্থা ছিল মর্মান্তিক, শ্রমিকদের মজুরি ছিল সামান্য; বাসস্থানগুলি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
[৫] বেকার সমস্যার সৃষ্টি: শ্রমিকদের চাকুরির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। মালিকের খেয়ালখুশির ওপর তারা নির্ভরশীল ছিল। কর্মচ্যুত শ্রমিকের অন্নসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লবের ফলে বেকার সমস্যার উদ্ভব হয়।