শিল্প বিপ্লবের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব আলোচনা করো

শিল্প বিপ্লবের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব আলোচনা করো
শিল্প বিপ্লবের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব আলোচনা করো

সূচনা

ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে শিল্পবিপ্লবের ফলাফল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। শিল্পবিপ্লব বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। বর্তমান যুগে শিল্পোৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে যে নতুন সভ্যতার উন্মেষ হয়েছে তা ‘শিল্পাশ্রয়ী সভ্যতা’ নামে পরিচিত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে শিল্পবিপ্লব এক নতুন যুগের সূচনা করে। প্রাচীন কুটির শিল্প, গ্রামীণ অর্থনীতি, সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রভৃতির স্থানে দেখা দেয় শিল্পাশ্রয়ী সভ্যতা, নগরজীবন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও উদারনৈতিক আদর্শ।

নতুন শিল্প সমাজের উদ্ভব

শিল্পবিপ্লবের পূর্বে সমাজ ছিল কৃষিনির্ভর ও কুটিরশিল্পভিত্তিক। এই সমাজে কর্তৃত্ব করত ভূস্বামী ও অভিজাতবর্গ। শিল্পবিপ্লবের পর নতুন যে সমাজ গড়ে ওঠে, তা ছিল নগরভিত্তিক ও যন্ত্রনির্ভর বৃহদায়তন শিল্পভিত্তিক। এই সমাজে দুটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়- পুঁজিপতি মালিক ও শোষিত শ্রমিক। পুঁজিপতিরা কারখানা স্থাপন, শ্রমিক নিয়োগ ও মূলধন বিনিয়োগ করে প্রচুর মুনাফা লুটতে থাকে। অপরদিকে শ্রমিকরা শ্রমদান করে পণ্য উৎপাদন করত এবং বিনিময়ে মজুরি পেত। কারখানা, যন্ত্র বা উৎপাদিত পণ্যের ওপর তাদের কোনো অধিকার ছিল না। শ্রমিকদের দুর্দশা ছিল সীমাহীন। তাদের মজুরি ছিল সামান্য, কাজ ছিল বৈচিত্র্যহীন এবং কাজের সময় ছিল পনেরো থেকে ষোল ঘন্টা। তাদের চাকরির কোনো নিরাপত্তা ছিল না। ঘনবসতিপূর্ণ নোংরা অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে তারা বাস করত। এইভাবে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের শোষণ করে শিল্পমালিক অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয় হয়।

নতুন শহরের বিকাশ

শিল্পবিপ্লবের আগে অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত এবং তাদের পেশা ছিল কৃষিকার্য। কৃষির ফাঁকে ফাঁকে তারা কিছু শিল্পকর্মে নিযুক্ত ছিল। মানব-সভ্যতার সূচনায় কিছু কিছু শহর গড়ে ওঠে, যেখানে সাধারণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদন চলত। শিল্পবিপ্লব অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। এ সময় ম্যাঞ্চেস্টার, লিভারপুল, হ্যাম্পশায়ার, গ্ল্যাসগো, মিউল্যান্ডস, ইয়র্কশায়ার প্রভৃতি নতুন শহরগুলি গড়ে ওঠে। কারখানার বিকাশ, শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি ও বাণিজ্যের কারণে শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

গ্রাম থেকে শহরে অভিপ্রয়াণ: গ্রামের কৃষকরা কর্মসংস্থান ও মজুরির আশায় গ্রাম ত্যাগ করে দলে দলে শহরে আসতে শুরু করে। এর ফলে একদিকে গ্রামগুলির জনসংখ্যা কমে যায় এবং অন্যদিকে শহরগুলি জনবহুল হয়ে ওঠে। ১৭৫০ সালে ৫০ হাজার-এর বেশি মানুষ বাস করে- ইংল্যান্ডে এমন শহরের সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি- লন্ডন এবং এডিনবরা। ১৮০১-এ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮-এ। ১৮৫১-তে হয় ২৯টি এবং এর মধ্যে আগের ৯টি শহরের জনসংখ্যা ছিল ১ লক্ষের বেশি। গ্রামীণ মানুষদের শহরে আগমন এবং শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি গ্রাম ও শহরগুলিতে নানা সমস্যা তৈরি করে। গ্রামগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে- বহু ক্ষেত্রে কৃষকের অভাবে চাষবাস বন্ধ হয়ে যায়। শহরগুলি জনবহুল, ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। কারখানাগুলিতে মালিকের উৎপীড়ন, শিশু শ্রমিক নিয়োগ প্রভৃতি নানা সমস্যা সৃষ্টি করে।

বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ

শিল্পবিপ্লবের পূর্বে ধনী ব্যক্তিরা বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ করতেন। বাণিজ্যে নিয়োজিত এই মূলধন বাণিজ্যিক মূলধন নামে পরিচিত। শিল্পবিপ্লবের পর ধনী ব্যক্তিরা ব্যবসা-বাণিজ্য অপেক্ষা পণ্যাদি উৎপাদনের জন্য শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকেন। এই মূলধন ‘শিল্প মূলধন’ নামে পরিচিত। শিল্পবিপ্লবের পর ‘বাণিজ্যিক মূলধন’ ধীরে ধীরে ‘শিল্প মূলধনে’ বুপান্তরিত হয়। আগেকার যুগের সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণির অবলুপ্তি ঘটে এবং শিল্পপতি, বণিক ও মহাজন প্রভৃতির সমন্বয়ে নতুন এক শাসক শ্রেণির আবির্ভাব হয়। এরা নতুন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পত্তন করে। এই ব্যবস্থায় বুর্জোয়া- পুঁজিপতিরাই সমাজের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎপাদন ব্যবস্থা ও শিল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে। তারা শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করত, দ্রব্যমূল্য ঠিক করে দিত এবং শ্রমিকদের কম মজুরি দিত। এইভাবে তারা ধীরে ধীরে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। ধনবান এই ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্যোগ নেয়। এইভাবে সমাজে বুর্জোয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ হতে থাকে।

অর্থনৈতিক সম্পদ বণ্টনে বিভাজন ও বৈষম্য

শিল্পবিপ্লব সমাজে মালিক ও শ্রমিক বলে কেবলমাত্র দুটি শ্রেণিরই সৃষ্টি করে নি- অর্থনৈতিক সম্পদ বণ্টনে বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টি করে সমাজজীবনে ঘোরতর সংকটের সৃষ্টি করেছিল। সমাজের ওপরতলার মানুষদের জীবন ছিল আরামপ্রদ ও সুখকর। ভূস্বামী, মালিক, পুঁজিপতি, বিভিন্ন পেশার মানুষ, আইনজীবী, যাজক সবার অবস্থাই ছিল সচ্ছল। অন্যদিকে শ্রমিক, কৃষক, ছোট ব্যবসাদার, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। পুঁজিপতি মালিক মুনাফার মাধ্যমে সব সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ন্যূনতম মজুরি দিয়ে শ্রমিককে কাজ করান। এইভাবে সমাজে মালিক ও শ্রমিক নামে দুটি পরস্পরবিরোধী শ্রেণির সৃষ্টি হয়।

নতুন শ্রেণির উদ্ভব

শিল্পায়ন ও শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে বেশ কিছু নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়। মালিক ও শ্রমিক তো আছেই। এছাড়া, নতুন শিল্পপতি, বণিক, কারখানার মালিক, ব্যবসায়ী, মহাজন, ব্যাঙ্কার, জাহাজ ও পরিবহনের মালিক এবং কেরানি প্রভৃতিদের নিয়ে গড়ে ওঠে এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। এরা পুরোন অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠে।

ফ্যাক্টরি বা কারখানা প্রথা [Factory system]

শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান প্রভাব হল ‘ডোমেস্টিক প্রথা’ তথা কুটির শিল্প থেকে ‘ফ্যাক্টরি প্রথা’ বা ‘কারখানা প্রথায়’ উত্তরণ। ডোমেস্টিক ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল পারিবারিক শ্রমের ব্যবহার এবং পারিবারিক পুঁজি ও ছোটখাটো যন্ত্রের ব্যবহার। এই ব্যবস্থার পরিধি ছিল ছোট। ফ্যাক্টরি ব্যবস্থায় একই ছাদের তলায় বিশাল জায়গা জুড়ে সমস্ত রকমের উৎপাদনের ব্যবস্থা করা 4 হয়। এজন্য প্রয়োজন ছিল বিশাল অঙ্কের পুঁজির, যা পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে যোগাড় করা সম্ভব ছিল না। তাই আবির্ভাব হল মূলধন মালিকের বা পুঁজিপতির। তাঁরা পুঁজি বিনিয়োগ করে, কাঁচামালের ব্যবস্থা করে, নতুন উদ্ভাবিত যন্ত্র ব্যবহার করে ও মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগ করে দ্রুত উৎপাদনের ব্যবস্থা করেন। ক্রমে এই বিশাল ফ্যাক্টরিগুলিই শিল্প বিপ্লবের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো।

Leave a Comment