শিল্প বিপ্লব কীভাবে উপনিবেশের জন্ম দিয়েছিল

শিল্প বিপ্লব কীভাবে উপনিবেশের জন্ম দিয়েছিল
শিল্প বিপ্লব কীভাবে উপনিবেশের জন্ম দিয়েছিল

শিল্পবিপ্লব ও উপনিবেশ স্থাপন

শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের অর্থনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন আসে। কলকারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রির পরিমাণ অভাবনীয়-রূপে বৃদ্ধি পায়। এইসব পণ্যাদি বিক্রির জন্য বাজারের প্রয়োজন হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ বস্ত্র, যন্ত্র, লোহা ও অন্যান্য ধাতুনির্মিত পণ্যের ভাল বাজার ছিল ইউরোপ। কিন্তু ১৮৭০-এর পর জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও অন্যান্য দেশ তাদের দেশীয় বাজারে পণ্যের অভাব মিটিয়ে ফেলে। দেশীয় পণ্যকে রক্ষা করার জন্য এইসব দেশ ‘শিল্প সংরক্ষণ নীতি’ গ্রহণ করে এবং ব্রিটিশ পণ্যের ওপর চড়া হারে শুল্ক বসায়। এইভাবে তারা ব্রিটিশ পণ্যের আমদানি বন্ধ করে দেয়। ক্রমে এইসব দেশেও পণ্য উদ্বৃত্ত হতে থাকে এবং তারাও বাইরে বাজার খুঁজতে থাকে। ইউরোপে ফাঁকা বাজার ছিল না। একারণে প্রত্যেক রাষ্ট্রই শিল্পে অনুন্নত এশিয়া ও আফ্রিকার দিকে নজর দেয়। কাঁচা মালের জোগান, ইউরোপীয় পণ্যের বাজার এবং সর্বোপরি সস্তায় শ্রমিক সংগ্রহ প্রভৃতি দিক থেকে এই দেশগুলি ছিল খুবই লোভনীয়। বাজার দখল, কাঁচামাল সংগ্রহ 4 এবং বাণিজ্যিক লগ্নীর কারণে এই দেশগুলিতে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ স্থাপন

সূচনা: উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য তেমন কোনও আগ্রহ দেখা যায় নি- বরং এই সময় বহু ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য (স্পেন ও পতুগালের) ভেঙে পড়তে থাকে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ১৭৮৩ থেকে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ হল ইংল্যান্ডের একাধিপত্যের যুগ। ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ‘সাম্রাজ্যবাদের যুগ’ হিসাবে চিহ্নিত। এই সময় ইউরোপীয় শক্তিগুলি এশিয়া, আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে অগ্রসর হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই এইসব অঞ্চলে শুরু হয় ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা।

এশিয়া

এশিয়া মহাদেশ ছিল ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীগুলির কাছে এক লোভনীয় ক্ষেত্র। কাঁচামাল ও খোলা বাজার দখল এবং বিধর্মীদের মধ্যে ধর্মপ্রচার প্রভৃতি বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী এশিয়া মহাদেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমে তারা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য-কুঠি নির্মাণ করে। তারপর ধীরে ধীরে ওইসব দেশে তারা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এইভাবে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল তাদের অধীনে আসে।

ভারত ও সন্নিহিত অঞ্চল

  • ভৌগোলিক অবিষ্কারের পর থেকেই ইউরোপের বণিক সম্প্রদায় ভারতে আসতে থাকে। ভাস্কো-ডা-গামার সঙ্গে পোর্তুগিজরা প্রথম ভারতে আসে এবং গোয়া, দমন, দিউ-তে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই অঞ্চলগুলি পোর্তুগালের সাম্রাজ্যের অংশ হয়।
  • এ কাজে সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করে ইংরেজরা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর ইস্ট-ইন্ডিয়া ই কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত পরিণত হয় ব্রিটিশ পণ্যের খোলা বাজার ও কাঁচামাল সংগ্রহের উৎসে। 
  • ভারতের পূর্ব সীমান্তে ত্রয়দেশ (বর্তমান মায়ানমার) অবস্থিত। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পর পর তিনটি যুদ্ধ দ্বারা সমগ্র ব্রহ্মদেশ ইংরেজদের দখলে আসে। 
  • ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত আফগানিস্তান নিয়ে সমস্যা ছিল। সেখানে রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে, তা ভারতীয় সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকারক হত। আফগানিস্তানের সঙ্গে পর পর দুটি যুদ্ধ দ্বারা আফগানিস্তানে কিছুটা ইংরেজ প্রভাব স্থাপিত হলেও, সে দেশে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি। শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান ভারত ও রাশিয়ার মধ্যবর্তীস্থানে একটি নিরপেক্ষ দেশ বা ‘বাফার ‘রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আফগানিস্তানের সূত্র ধরে খাইবার গিরিপথ, সিন্দু, বেলুচিস্তান ও সীমান্তের কয়েকটি উপজাতীয় এলাকায় ইংরেজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়া অবশ্য এই অঞ্চলে তার বিস্তারনীতি অব্যাহত রাখে। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া মার্ভ অধিকার করে। পরের বছর হিরাটের দিকে অগ্রসর হয়ে তারা একেবারে পাঞ্জাবের কাছে এসে উপস্থিত হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

  • ওলন্দাজরা ইস্ট ইন্ডিজ বা ইন্দোনেশিয়ায় (জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণিও এবং বালি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত) আধিপত্য স্থাপন করে। 
  • সিংহল বা শ্রীলঙ্কাতে-ও তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সিংহল ইংল্যান্ডের অধিকারে আসে। 
  • মালয়ে প্রথমে পোর্তুগিজদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ধীরে ধীরে সিঙ্গাপুরসহ সমগ্র মালয়ের উপর ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  • অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইন্দোচিনে ফরাসি প্রভাবের সূচনা হয়। কালক্রমে এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য সম্প্রসারিত হতে থাকে। উনিশ শতকের শেষদিকে কোচিন-চিন, কম্বোডিয়া, আন্নাম ও লাওস ফরাসি শাসনাধীনে আসে। ইন্দোচিন ও ব্রহ্মদেশের মধ্যবর্তীস্থানে শ্যামদেশ অবস্থিত। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড শ্যামদেশের কিছু কিছু অঞ্চল দখল করলেও শ্যামদেশ তার স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
  • ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের উপর স্পেনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় দুশো বছর সেখানে স্পেনের শাসন চলে। ফিলিপাইনের জনগণ স্পেনীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমেরিকা ফিলিপাইনে স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ফিলিপাইনে মার্কিন কর্তৃত্ব শুরু হয়। জনগণ এর বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এতে কোনও লাভ হয় নি- কালক্রমে সমগ্র ফিলিপাইন মার্কিন অধিকারে চলে যায়। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ দখল করে সেখানে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।

মধ্যপ্রাচ্য

উনিশ শতকে পারস্যকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ-বুশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। কালক্রমে পারস্যে দুটি প্রভাব বলয় গড়ে ওঠে। দেশের উত্তরাংশে রাশিয়া এবং দক্ষিণাংশে ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

দূরপ্রাচ্য

দূরপ্রাচ্যে চিনে ওলন্দাজ, ইংরেজ, স্পেন, ফ্রান্স, সুইডেন প্রভৃতি দেশ ও জাতি উপনিবেশ বিস্তারে অগ্রসর হয়। জাপানের ওপর প্রথম আঘাত হানে আমেরিকা। তারপর ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও রাশিয়া জাপানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আফ্রিকা

উনিশ শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত আফ্রিকা ইউরোপীয়দের কাছে অজ্ঞাত ও অনাবিষ্কৃত ছিল। তাদের কাছে আফ্রিকা ছিল ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’। তারপর ধীরে ধীরে ওলন্দাজ, পোর্তুগিজ, ফরাসি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ইতালি, স্পেন প্রভৃতি দেশ ও জাতি আফ্রিকার বিভিন্ন অংশ দখলের জন্য আফ্রিকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মধ্যে আফ্রিকাকে ভাগ করে নেয়।

Leave a Comment