শিশুকন্যার প্রতি সামাজিক কর্তব্য রচনা

শিশুকন্যার প্রতি সামাজিক কর্তব্য রচনা

শিশুকন্যার প্রতি সামাজিক কর্তব্য রচনা
শিশুকন্যার প্রতি সামাজিক কর্তব্য রচনা

‘কন্যা আমাদের গৃহের এক মস্ত ভার। কন্যাদায়ের মতো দায় নাই।…..একান্ন পরিবারে আমরা দূর ও নিকট, এমন কি নামমাত্র আত্মীয়কেও বাধিয়া রাখতে চাই। কেবল কন্যাকেই ফেলিয়া দিতে হয়।’

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভূমিকা

হৃদয়ের মর্মান্তিক বেদনার কথা, পক্ষপাতপূর্ণ সমাজ -শাসনে কন্যার বলিদানের কথা শুধু একান্নবর্তী পরিবারের চিরন্তন কাহিনি নয় সমগ্র ভারত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানের সমগ্র হৃদয়-বিদারক কন্যার কাহিনির কথা। বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে পিতামাতার কন্যা-সন্তান যেন পরিবারের কাছে দায়ের বোঝা। সমাজ-অনুশাসনের সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে পিতামাতা তার কন্যাকে বিবাহ দিয়ে দায় থেকে অব্যাহতি চায়। যার ফলে কন্যারা সারা জীবন যন্ত্রণার মৃত্যুগৃহে থেকে মর্মবেদনার দাবানলে পুড়ে দিশেহারা হয়। সাবিত্রির মতো সতীসাধবী হওয়ার নিস্ফল আর্শীবাদ মাথায় নিয়ে অশ্রুপূর্ণ নয়নে কন্যারা দিনযাপন করে। তারা ধূপের মতো গন্ধ বিলায়, কিন্তু নিজেরা জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে যায়।

নারীর বিষাদ কাহিনি

নারী জাতি যুগ যুগ ধরে প্রেমপ্রীতিপূর্ণ সুখী পরিবার রচনার স্বপ্ন চোখে নিয়ে এই ভাবে তাদের দুঃখের-তরী ভিড়ায় হৃদয়হীন সংসার উপকূলে। নারীর প্রেমপ্রীতিপূর্ণ ঘর বাঁধার স্বপ্ন স্বার্থপর দুষ্ট পুরুষ শাসিত সমাজের লোভ-লালসার অগ্নিশিখায় দিনে দিনে দগ্ধ হতে থাকে। নারী তার জীবনের ব্যথা- বেদনার অভিশাপ মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন নিক্ষিপ্ত হয়েছে-দুর্যোগের ভাগ্য- উপকূলে। পুরুষ শাসিত সমাজের নির্লজ্জ স্বার্থপরতায় পণ্য-বিকিরণের মানদন্ডে মুদ্রা-রাক্ষসের শাসন-পীড়ন-অত্যাচারের নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছে মেয়েরা। একবিংশ শতাব্দীতে পা রেখে ও আমাদের সমাজের মান্ধাতা আমলের নারীদের প্রতি বৈষম্য মূলক অচারণের পরিবর্তন আশানুরূপ হয়নি। নিপীড়িত নারীর হৃদয়েরর বেদনা সুবিচার না পেয়ে মাথা কুটে মরে অন্ধ সমাজের স্বার্থপরের বন্ধ-দুয়ারে।

নারীর জীবনের মূল্যবোধ

আমরা যতই বলি সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার, কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। এখনও নারীকে পুরুষের অন্যায়-অবিচার মাথায় নিয়ে নীরবে অশ্রুমোচন করতে হয় যে তা সত্যি সমাজ ব্যবস্থার এক কলঙ্ক জনক অধ্যায়। নারীরা শারীরিক দিক থেকে পুরুষের তুলনায় রুক্ষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করার সমান ক্ষমতার অধিকারী না হওয়ায় সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকে পৃথিবীর সব দেশেরই নারীকে দেখা হয়েছে বিনোদনের সামগ্রী রূপে। পুরুষশাসিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অবাধ স্বাধীনতা লাভ করে পুরুষেরা। যুগের পর যুগ বদলেছেশতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেছে। প্রতিদিন সূর্য ওঠে সকালে, কিন্তু নারীর ভাগ্যে সৌভাগ্যের সূর্য এখন ও মলিন। 

ভারতে নারীর স্থান

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় সভ্যতার রথ এগিয়ে চলেছে আপন নিয়মে। যুগের পরিবর্তনে নারীজাতির মুক্তির বাণী ঘোষিত হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের মতো মহিষীদের কণ্ঠে। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের মতো সমাজ সংস্কারকগণ এগিয়ে এসেছেন নারীদের দুঃখের শরিক হয়ে, অন্ধ-সংস্কারপূর্ণ সমাজের অচলায়তন ভেঙে তাদের যোগ্য সম্মান দিতে। আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান সমস্ত ক্ষেত্রে। তবুও একশ্রেণীর মানুষ নারীদের ওপর যে পাশবিক অত্যাচার করছে তা সর্বজন স্বীকৃত। প্রশ্ন জাগে, সীতা-সাবিত্রী- খনা-লীলাবতীর দেশে কেন আজও বধূর কাছে তাদের পতিগৃহ জতুগৃহের রূপ ধারণকরে? কোন কোন রাষ্ট্র ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নারীদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করলেও উন্নত দেশগুলি চেষ্টা করছে পুরুষের সাথে নারীদের সমান আসনে প্রতিষ্ঠত করতে।

নারী নির্যাতনের কারণ

নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ শিক্ষার অভাব। শিক্ষা মানুষকে সংস্কার মুক্ত করে, শিক্ষা আলোকিত করে মানুষের বিবেকবোধকে। ভারতে নারীর পরিচয় কন্যা, পত্নী, জননী রূপে। অধিকার পাওয়া এবং তা রক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করা-উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নারীদের যে স্বতন্ত্র্য সত্তা আছে তা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। এখন প্রত্যেক উন্নতশীল দেশ শিশু-কন্যাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও উপযুক্ত মানসিক বিকাশের জন্য সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহন করছে। শিশুকন্যাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ রচনার প্রয়োজনে পিতামাতা ও সমাজকে যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে, নারীদের ও সচেতন হতে হবে তাদের অধিকার রক্ষায়।

উপসংহার

ভারতের মতো উপমহাদেশের শিশুকন্যাদের যে সমস্যা, তা হলো শিক্ষাগত, সমাজগত, অর্থনীতিগত। তার সাথে যোগ হয়েছে দারিদ্র-অপুষ্টি। শিশুকন্যারা অবর্ণনীয় অশিক্ষা ও ক্ষুধার শিকার হচ্ছে। তাই দারিদ্র বিনাশ না করতে পারলে নারীমুক্তি ও শিশুকন্যাদের সমস্যা দূর করা সহজ হবে না। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পিতামাতার পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিও শিশুকন্যার অবহেলার কারণ হয়। এইসব বাধা অপসারণ না হলে শিশুকন্যার সুস্থ বিকাশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না।

Leave a Comment