সফিস্ট কারা? এই গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

সফিস্ট কারা? এই গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

সফিস্ট কারা? এই গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
সফিস্ট কারা? এই গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

সফিস্টদের পরিচয়

গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে বিশেষভাবে আলোকিত করার ক্ষেত্রে সফিস্ট (Sophist) দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সফিস্টরা ছিলেন একশ্রেণির যুক্তিবাদী বক্তা ও পণ্ডিত। গ্রিক শব্দ Sophia (দিব্যজ্ঞান) থেকে Sophist শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। সফিস্ট- এর প্রচলিত অর্থ হল, কু-তর্ককারী। আবার এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার লেখকের মতে, Man of wisdom. প্লেটো লিখেছেন যে, সফিস্টাই (Sophastai) বা জ্ঞানব্রতী কথাটি থেকে সফিস্ট কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে আবির্ভাব ঘটে সফিস্ট পণ্ডিতদের। গ্রিস দেশে, বিশেষত এথেন্সে গণতন্ত্র প্রসারের পর সমাজে সুবক্তাদের কদর বাড়তে থাকে। এসময় রাজনৈতিক বিতর্কে যুক্তি ও তথ্য দ্বারা বিরোধীপক্ষকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করার রীতি জনপ্রিয় হয়। সাহিত্য, বাগ্মিতা, রাষ্ট্রদর্শন এবং পরিচালনা ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে নতুন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে একদল পণ্ডিত এগিয়ে আসেন। তাঁদের বলা হয় সফিস্ট।

শিক্ষাদান পদ্ধতি

সফিস্টরা মানুষকেই শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচনা করতেন। গ্রিক সমাজের নানান ক্ষেত্র থেকে সফিস্ট দার্শনিকদের আবির্ভাব ঘটেছে। এঁদের মধ্যে ছিলেন ভাষাবিদ, ব্যাকরণবিদ, তার্কিক প্রমুখ। তবে এঁরা যে সংগঠিতভাবে কোনও রাষ্ট্রতত্ত্ব প্রচার করেছেন, এমনটা নয়। প্রকৃতপক্ষে সফিস্টদের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। এঁরা বিভিন্ন নগররাষ্ট্রে ঘুরে ঘুরে নানান বিষয়ে বক্তৃতা দান করতেন। যুক্তি ও সমালোচনা দ্বারা প্রতিপক্ষের ধ্যানধারণাকে কীভাবে নস্যাৎ করা যায়- এই প্রকার শিক্ষা পাওয়া যায় সফিস্টদের কাছে। মূলত দার্শনিক, তর্কবিদ ও শিক্ষক হলেও এঁদের চিন্তাভাবনা রাষ্ট্রজীবনের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক ছিল।

কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সফিস্ট দার্শনিকের পরিচয়

(i) প্রোটাগোরাস

প্রোটাগোরাস (Protagoras, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-৪৩০ অব্দ) ছিলেন গ্রিসের প্রাচীনতম এবং শ্রেষ্ঠ সফিস্ট চিন্তাবিদ। “Man is the measure of all things…” অর্থাৎ, মানুষই হলেন সব বিচারের মাপকাঠি- এই ছিল প্রোটাগোরাসের বিখ্যাত উক্তি। সক্রেটিসের আগে তিনিই দর্শনচর্চায় অধ্যাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন। প্রোটাগোরাস ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এমন কোনও ধারণাকে স্বীকার করেননি। তাঁর মতে, পরম বা চরম সত্য বলে কিছু হয় না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিস্থিতি অনুসারে সত্য নির্ধারিত হয়। তাই সত্য-সুন্দরের ধারণা আপেক্ষিক। বার্কার-এর মতে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হলেও, প্রোটাগোরাস রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অস্বীকার করেননি। তাঁর মতে ব্যক্তির প্রয়োজনেই রাষ্ট্র। সমাজ ও রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রোটাগোরাস শাস্তিদানের প্রয়োজন স্বীকার করেন। তবে সেই শাস্তি কখনোই প্রতিশোধমূলক হবে না; তা হবে সংশোধনমূলক।

(ii) অ্যান্টিফন

অ্যান্টিফন (Antiphon, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০-৪১১ অব্দ) ছিলেন অপর একজন বিশিষ্ট সফিস্ট চিন্তাবিদ। নীতি ও রাজনীতির সঙ্গে যে প্রাকৃতিক জগতের এক বিশেষ সংযোগ রয়েছে- একথা তিনি বিশ্বাস করতেন। অ্যান্টিফনের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক আইন রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে বড়ো। জাতীয় সংস্কারের বেড়াজাল থেকে এই চিন্তাবিদ ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। বিশ্বজনীন আদর্শের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাস্তবতাই ছিল অ্যান্টিফনের চিন্তার মূল বিষয় এবং তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক জগতের যেখানে মানুষ মানুষের পরিচয়েই বসবাস করবে।

(iii) হিপ্লিয়াস

প্রোটাগোরাস ও সক্রেটিসের সমসাময়িক ছিলেন এই বিশিষ্ট সফিস্ট দার্শনিক। হিপ্পিয়াস (Hippias, আনুমানিক ৫৭০-৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) কবি ও সংগীতজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণিত প্রভৃতি বিষয়েও সমান পারদর্শী ছিলেন। তাঁর মতানুযায়ী, প্রত্যেকটি মানুষকে তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী রসদ বা সম্পদ সংগ্রহ করতে হবে। নগরজীবনের কৃত্রিমতাকে তিনি একেবারে মানতে পারতেন না। প্লেটোর রচনা থেকে জানা যায় যে, হিপ্পিয়াস মনে করতেন সকল মানুষ প্রকৃতিগত দিক থেকে একে অন্যের আত্মীয়-মানুষের তৈরি প্রথায় যদিও তার কোনও স্বীকৃতি নেই। আর এই প্রথাই মানুষকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নানান কাজ করতে বাধ্য করে।

(iv) জর্জিয়াস

দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের একজন বিদগ্ধ শিক্ষক হিসেবে সিসিলিতে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন সফিস্ট দার্শনিক জর্জিয়াস (Gorgias, আনুমানিক ৪৮৩-৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। মূলত তাঁর দর্শন ছিল অজ্ঞেয়বাদী দর্শন। তিনি বলেছেন যে- এই বিশ্বে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই, যদি কিছু বিদ্যমান থাকে তা আবার জানার উপায় নেই। আর যদি কোনও কিছু জানাও যায় সেটি ব্যাখ্যা করা বা অন্যকে জানানোর উপায় নেই। Encomium of Helen, Epitaphios, On Non-Existence or On Nature ইত্যাদি রচনায় জর্জিয়াসের দার্শনিক তত্ত্বের পরিচয় মেলে।

(v) থেসিমেকাস

প্লেটো তাঁর রচনায় সক্রেটিসের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত যেসকল সফিস্ট দার্শনিকদের নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, থ্রেসিমেকাস (Thrasymachus, আনুমানিক ৪৫৯- ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ন্যায়নীতি বা Justice বিষয়ে বক্তব্যের জন্য থ্রেসিমেকাস বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর মতে Might is justice অর্থাৎ বাহুবলই ন্যায়।

পরিশেষে বলা যায়, সফিস্টরাই প্রথম প্রকৃতির রাজ্য থেকে মানুষের দিকে নজর দিতে শেখান। এঁরাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনের জনক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল-এর মতে, সফিস্টরাই প্রথম ঘোষণা করেন যে রাষ্ট্র ‘সামাজিক চুক্তি’ দ্বারাই সৃষ্ট। অ্যারিস্টটল আবার সফিস্টদের অর্থলোভী জ্ঞান-বিক্রেতা বুদ্ধিজীবী বলে নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই অভিযোগ যথার্থ নয়। কারণ, তাঁরা শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থদানের উপর নির্ভর করতেন। সফিস্টরাই সর্বপ্রথম মানুষকে স্বাধীন সত্তার অধিকারী হিসেবে সচেতন করে তোলার কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন।

আরও পড়ুন – গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

Leave a Comment