সমাজ গড়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে বিবর্তিত হয়ে যার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের সমাজ জীবনের বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি। সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক ঘূর্ণাবর্তের প্রবাহের ঘাত-প্রতিঘাতে সৃষ্টি হচ্ছে নব-রূপরঙ্গ তরঙ্গাবর্তিত হয়ে। সেই রূপ-রঙ্গ-তরঙ্গ সাহিত্যের রূপময়তায় হয়ে উঠছে অপরূপ শিল্পায়িত। সৃষ্টির জগতে সাহিত্যিক অবতীর্ণ হন জীবন-শিল্পী রূপে তাঁর রচনা-নৈবেদ্য সমাজকে উপহার দিয়ে।
সাহিত্য সমাজ ও জীবনের দর্পণ
প্রকৃতির রূপ-রঙ্গশালা সমাজের হিরন্ময় পাত্রে উদ্ভাসিত হয়ে জীবনরঙ্গ মানুষের দৃষ্টি নিক্ষেপে করে তুলে জগতে দৃশ্যমান। যেখানে যে নিত্য প্রবহমান জীবন ধারা সামাজিক প্রেক্ষাপটে শত মানবের কর্ম- কোলাহল ও সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে দিক-দিগন্ত মুখরিত করে যুগ থেকে যুগান্তরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, তাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকাশ করে সাহিত্য। তাই তো সাহিত্য হল সমাজ-দর্পণ। সেই দর্পণে প্রতিফলিত হয় দেশ-কালের- সমাজের ছবি।
বেদব্যাসের মহাভারত, বাল্মীকির রামায়ণ, কালিদাসের শকুন্তলা, টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পীস’, রবীন্দ্রনাথের গোরা, গোর্কির ‘মাদার’ প্রভৃতি গ্রন্থে আমরা খুঁজে পাই সমাজের আসল রূপ।
সাহিত্য চিরন্তন দেশ-কাল-অতিক্রম করে: সাহিত্যে স্থান লাভ করে সমাজ, সমাজ-জীবন। কিন্তু সাহিত্য দেশকালবদ্ধতার নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে নিঃশেষিত হয় না। সাহিত্য স্রষ্টার সৃষ্টি-কৌশলের অপরূপ শিল্প-সৌকর্যে সমকালীনতার সীমা- বন্ধন অতিক্রম করে চিরকালের জগতে উত্তীর্ণ হয়। স্রষ্টার শিল্প-প্রতিভার অনুপম রূপসৃষ্টির চিরন্ততার জয়টিকা ললাটে পরে তা হয়ে উঠে সমকালীন, সর্বজনীন। ক্ষণকালের সৃষ্টি হয়ে যায় চিরন্তন, তার মধ্যে স্থায়ী আসনে উপবিষ্ট থাকে সমকালীন সমাজ ও তার রূপচ্ছবি। তখন নীরব হলেও পরিবর্তনশীল সমাজ ও সময়ের প্রেক্ষাপটে সে হয়ে ওঠে মুখর-বাত্ময়।
সমাজও এক মহাশিল্পী
সাহিত্য সৃষ্টির উপকরণ সামাজিক প্রেক্ষাপট বা বিশ্ব- প্রকৃতির বাইরের থেকে সংগৃহীত হলেও স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টি-সাম্রাজ্যের সম্রাট। ‘সৃষ্টিকর্তা তার রচনাশালায় একলা কাজ করে। সে বিশ্বকর্মার মতন আপনাকে রচনা করে।’ কিন্তু সেই স্রষ্টার দৃষ্টি গোচরের বাইরে আর এক মহাশিল্পী সৃষ্টির সাথে যুক্ত হয়, তা হল সমাজ, সেও মহাশিল্পী। সে স্রষ্টার অচেতন মনের গোপন সিঁড়ি বেয়ে সাহিত্যের দর্পনে রচনা করে যায় তার মুখের প্রতিচ্ছবি, তা তার জীবন-বেদ, তাই সাহিত্য-শিল্পী তাঁর সমকালীন সমাজকে অস্বীকার করতে পারে না। শুধু বর্তমান সময়ে নয়, প্রাচীন-মধ্যযুগের কবি সাহিত্যিকের রচনা সম্ভারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সেকালের সমাজের নির্ভুল মুখচ্ছবি।
সাহিত্য সৃষ্টির উপকরণ আহৃত হয় সমাজ থেকে
যিনি সাহিত্য-সম্রাট, যাঁর মধ্যে সাহিত্যের নব-নব রূপ আত্মপ্রকাশের জন্য উন্মুখ, সমাজের জীবন্ত পক্ষপুটে চেপে তাঁকে রচনা করতে হয় সমাজ-জীবন, যার অনিবার্য প্রভাব মানুষের অন্তর্জীবন ও বর্হিজীবন- উভয় ক্ষেত্রেই সঞ্চারিত হয়। সমাজ ও এক প্রাণময় চলমান সত্তা। সাহিত্য স্রষ্টার থাকে অসাধারণ অনুভব-ক্ষমতা ও উপলব্ধি শক্তি। পৃথিবীর নানা ঘটনা-তরঙ্গ, সমাজের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তার অনুভূতির আলোকে সৃষ্টি করে নব-সৃষ্টির আবর্ত। সেই আবর্তে সৃষ্ট এক অনির্বচনীয় ভাবরস সঞ্চিত হয় তার চেতনা লোকে। এই সমাজই মানব-জীবনের মহা-সমুদ্র। স্রষ্টা তাতে ডুব দিয়ে সেখান থেকে তুলে আনেন সাহিত্য-কাননের পারিজাত। তারপর ভরিয়ে দেন সাহিত্যের আঙিনা। সমাজের পরিপ্রেক্ষণী থেকে সংগৃহীত অভিজ্ঞতার রঙে তাকে রাঙিয়ে দেয় তার পূর্ণ-রূপ।
সাহিত্যিক দ্রষ্টা ও স্রষ্টা
সমাজ সৃষ্টি করে সাহিত্য-সষ্টাকে, সাহিত্য স্রষ্টা সৃষ্টি করে সাহিত্য ও নানা সৃষ্টি কর্মকে। কোন কবি-সাহিত্যিক সমাজের অনতিক্রম্য অস্বিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন না। সমাজ শুধু স্থান কাল মানুষকে নিয়ে নয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, বিচার-অবিচার, আচার-সংস্থার প্রভৃতির যোগ ফল। সাহিত্যিক সমাজের সেই বৈচিত্র থেকে আহরণ করেন সৃষ্টির বৈচিত্র উপকরণ দ্রষ্টা হয়ে এবং তারপর স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সৃষ্টি করেন অমর সাহিত্য। সাহিত্যিক প্রত্যক্ষ করেন সমাজের ঘটনাপুঞ্জ, বস্তু-সম্ভার, বহু-বিচিত্র মানব-জীবনকে, যা তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন্ত ভাষা-শৈলীর সাহায্যে সৃষ্টি হয় সাহিত্য, সাহিত্য-চিত্রের মুক্ত বাতায়ন-পথে সমগ্র সমাজের রূপমূর্তি সমাজ ও সমকালের বিশ্বস্ত দলিল হয়ে থাকে।
উপসংহার
এইভাবে যিনি সাহিত্য-স্রষ্টা, তিনি সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সমাজ থেকে উপকরণ নিয়ে মেতে ওঠেন নতুন নতুন সৃষ্টি-খেলায়। ফলে তিনি যা সৃষ্টি করেন তা হয়ে ওঠে সার্বজনীন, সমাজের স্থায়ী দলিল রূপে, কালজয়ী।