সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনজীবনে তার প্রভাব রচনা

সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনজীবনে তার প্রভাব রচনা
সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনজীবনে তার প্রভাব রচনা

ভূমিকা

ভারতে জাতীয় উৎপাদনের হার আশানুরূপ না হওয়ায়, খরা, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে এবং ডিজেলের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এখন বেশিরভাগ মানুষের গা-সওয়া ব্যাপার। একথা ঠিক ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা’, কিন্তু সাম্প্রতিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে আমরা আধমরা। কারোর বা পৌষমাস, আবার কারোর সর্বনাশ। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের অবস্থা তো অসহনীয়, অন্যদিকে কিছু লোকের মুনাফা লাভ। প্রশাসনের গদাই লস্করী চাল, ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাব, রাজনীতির চাপান-উতোর, বন্ধ-হরতাল, সংবাদপত্রগুলির ইসু খুঁজে পেয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বাজার সরগরম। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই মূল্যবৃদ্ধিতে তেমন কোনো প্রতিবাদ মানুষের মধ্যে না থাকায় তা যেন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে বলেই মনে হয়।

ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ভূমিকা

আমাদের দেশে প্রতি বছর, প্রতি মাসে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আলু, তেল, ডাল, তরি-তরকারি, আদা, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, ডিম, মশলা প্রভৃতির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম একেবারে আকাশছোঁয়া। যে ডাল ভাত বাঙালির প্রিয় সেই ডালের কেজি ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পেঁয়াজের দাম উঠেছে আশি টাকা। লক্ষ করবার মতো, একবার কোন জিনিসের দাম বেড়ে গেলে তা আর সাধারণত কমে না। একথা সত্য যে, এই মূল্যবৃদ্ধি শুধু ভারতে নয়, সবদেশেই এই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। তবে মনে রাখা দরকার যে, পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে যখন দর বাড়ে তখন সমানুপাতিক আয়ও বাড়ে। কিন্তু ভারতের বেলায় ক্রমানুপাতিক হিসাবটা মেলে না। আয় এক পয়সা বাড়লে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ে তিন পয়সা। চাকুরীজীবীরা যদিও মহার্ঘ ভাতা পান, তাদের কিছু সুরাহা হয়, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

ভারতীয় অর্থনীতি ও মূল্যবৃদ্ধি

অর্থনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নতির পক্ষে সহায়ক। কিন্তু আমাদের দেশে তা হচ্ছে না। ভারতীয় অর্থনীতি চলছে গোঁজামিল দিয়ে। যে পরিকল্পনা ভারতীয় অর্থনীতি নেওয়া হচ্ছে সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়ণ করতে গিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে বা পাশ কাটিয়ে গিয়ে কাজ চলা গোছের একটা কিছু নীতি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী মনে করছেন-আমার জমানাটা কোন রকমে কাটিয়ে দিলেই হল, তারপর যা হয় হোক্। সেজন্য প্রয়োজন সুসংহত জাতীয় নীতি ও তার প্রণয়নের বাস্তবসম্মত উপায় এবং সে সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও মূল্যরেখার একটা সংগতি স্থাপন করা একান্ত জরুরি।

মূল্যবৃদ্ধির কারণ

মূল্যবৃদ্ধির কারণগুলি হল: (i) যে দেশে যথার্থ পরিকল্পনা ও মূল্যায়নের অভাব সে দেশে মূল্যবৃদ্ধি তো ঘটবেই। পরিকল্পনামাফিক রাজনীতিটাই হয়, অন্যের বেলা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। (ii) একবার এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই-এই | মূল্যবৃদ্ধির কারণ যদি কালোবাজারীদের প্রার্থনা হয় এবং সেই প্রার্থনা প্রত্যক্ষ বাদ পরোক্ষভাবে যদি নেতারা পূরণ করার পথ বের করে দেন, তাহলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটবেই। ভোট ভিক্ষা করবার সময় কত সুন্দর কথা, কি বিচিত্র বিনয় ও আশ্বাস, আর ভোট ফুরিয়ে গেলে নেতারা হয়ে যান ডুমুরের ফুল, সে দেশে তো মূল্যবৃদ্ধি ঘটবেই। (iii) শুধু নেতারাই বা দোষী হবেন কেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন প্রতিকারের ইচ্ছা নেই, নেই প্রতিবাদ, বরং হুজুগে মেতে সেই জিনিসটা বেশি করে ঘরে মজুত রাখলেই হল-এই যাদের মনোবৃত্তি তাদের মূল্যবৃদ্ধির ঠেলা সামলাতে হবে বৈ কি! (iv) হুজুগ ছড়িয়ে দিয়ে, মানুষের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করাটা আজকের সবচেয়ে বড় বিষয়। (v) অবশ্য কাঁচা তরি-তরকারির দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি বা বন্যা। (vi) জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মজুতদারদের অন্ধ স্বার্থসিদ্ধি, প্রশাসনের নিস্পৃহতা, পরিবহণের ব্যয়বৃদ্ধি, চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়া, উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব প্রভৃতি পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। (vii) করবৃদ্ধিও মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি কারণ। (viii) ফড়ে বা দালালদের মুনাফা সেইসঙ্গে পেট্রোল-ডিজেলের ধারাবাহিক দাম বাড়াও মূল্যবৃদ্ধির কারণ।

প্রতিকার

এ সমস্যার সমাধান করতে হলে (i) অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন এবং শুধু পরিকল্পনা করে বা মিটিং করে কিছু হবে না, বাস্তবে তাকে রূপায়িত করার জন্য পরিকাঠামো (ইনফ্রাস্ট্রাকচার) উন্নয়নের একান্ত প্রয়োজন। (ii) আমাদের দেশের বহু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম অভাব সৃষ্টিতে তৎপর। তারা অনেক সময় বেশি পরিমাণ পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখে এবং তারপর দেশে পণ্যের জন্যে যখন হাহাকার শুরু হয় তখন বাড়তি দামে মজুত করা পণ্য বাজারে ছাড়ে। এতে ওদের মুনাফার অঙ্ক রাতারাতি ফুলে ফেঁপে ওঠে, আর জনসাধারণের পকেট কাটা যায় পাইকারী হারে। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে ফাটকাবাজী ও মজুতদারি নির্মূল করা প্রয়োজন। (iii) যে সব রাজনৈতিক নেতারা এইসব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, মজুতদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভোটে লড়েন এবং তাদের এভাবে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তারা দেশের শত্রু। এদেরকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। (iv) সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে, আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, শুধুমাত্র কথার কামান দাগলে বা বক্তৃতার ফুলঝুরি ছোটালেই হবে না। (v) সাধারণ মানুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ‘পণ্যদ্রব্য নেই’ এই আশঙ্কায় তারা যদি কারণে-অকারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন ও ‘ভূত ভূত’ চিৎকার করেন তাহলে ওঝা সেজে একদল স্বার্থপর ব্যবসায়ী তাদের ওপর খবরদারি তো করবেই। (vi) সর্বোপরি দরকার সুষ্ঠু গণচেতনা, সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সদিচ্ছা। 

উপসংহার

জনগণের দিকে তাকিয়ে, তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। প্রয়োজন কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির যৌথ প্রচেষ্টা। টাকা ছাপিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ না করে কেন এই বৃদ্ধি, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া সরকারের উচিত। সেজন্য দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা নেওয়াও একান্ত জরুরি। প্রতি বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া হবে, কালোবাজারী ও মজুতদাররা ফাটকাবাজি করবে, আর সাধারণ মানুষ শুধু তার খেসারত দেবে—এই ধারণা চিরকাল চলতে পারে না। এর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। কৃষক আলুর দাম পাচ্ছে ৫ টাকা, বাজারে ক্রেতা কিনছে ১৫ টাকায় এই ব্যবস্থারও বদল হওয়া দরকার। তা না হলে প্রতি বছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হবে আর সাধারণ মানুষ ধৈর্যের পরীক্ষা দেবে-এ তো হতেই পারে না। তাই সমস্যার মোকাবিলা করা জরুরি-এখনই, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে।

Leave a Comment