সুফি আন্দোলনের ফলাফলগুলি লেখো

সুফি আন্দোলনের ফলাফলগুলি লেখো

অথবা, ভারতে সুফিবাদের গুরুত্ব বা প্রভাবসমূহ আলোচনা করো

অথবা, মধ্যযুগের সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা ও সাহিত্যের উপর সুফিবাদী আন্দোলনের প্রভাব কী ছিল

সুফি আন্দোলনের ফলাফলগুলি লেখো
সুফি আন্দোলনের ফলাফলগুলি লেখো

ভারতে সুফিবাদের ফলাফল/প্রভাবসমূহ

ভারতবর্ষে মধ্যযুগীয় ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রে সুফিবাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। সুফিবাদে প্রচারিত আদর্শগুলি সাধারণ মানুষকে যেমন আকৃষ্ট করেছিল, তেমনই তা শিক্ষা দিয়েছিল সামাজিক সাম্য ও সহনশীলতার।

(1) সুফিদর্শনের মাহাত্ম্য: সুফিসাধকদের সরলতা, আড়ম্বরহীন জীবনযাত্রা, ভগবতপ্রেম, মানবতাবাদ সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করেছিল। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভারতবাসী সুফিবাদের সর্বজনীন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন।

(2) সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব: সুফিবাদের প্রভাবে একদিকে যেমন ধর্মীয় উত্তেজনা প্রশমিত হয়, তেমনই এর সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শের কারণে তথাকথিত নিম্নকোটির অসহায় ও অস্পৃশ্য মানুষেরা সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। পাশাপাশি সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়ের সংস্থান মধ্যযুগের সমাজব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

(3) নৈতিক শিক্ষাদান: সুফিবাদী আন্দোলনের প্রচারকগণ ছিলেন চারিত্রিক ও নৈতিক পবিত্রতায় বিশ্বাসী। তাঁরা সুরাপান, ক্রীতদাস প্রথা, জুয়াখেলা ইত্যাদি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন।

(4)  হিন্দি ভাষা ও সংগীতের বিকাশ: হিন্দি ভাষা ও কাওয়ালি সংগীতের বিকাশে সুফিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যদিও ইসলাম ধর্মে সংগীত বর্জনীয়, তবু সুফিসাধকেরা মনে করতেন যে, পরমাত্মার সঙ্গলাভের যে আনন্দ, তা সংগীতের মাধ্যমে পাওয়া যায়। পাশাপাশি সুফিসন্তরা কথোপকথনের সময় হিন্দি ভাষা ব্যবহার করতেন এবং এই ভাষায় কবিতাও লিখতেন। এর ফলশ্রুতিতে হিন্দি ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

(5) বিদ্যাচর্চা ও বিদ্যালয়শিক্ষা: সুফি খান্কাগুলি কেবলমাত্র ধর্মচর্চার প্রতিষ্ঠানই ছিল না। বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানান্বেষণের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবেও দরগা বা খাকাগুলি ছিল প্রসিদ্ধ। অনেক খানকায় নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়শিক্ষা দান করা হত।

(6) ইসলামের ভারতীয়করণ: সুফিসাধকদের প্রয়াসে ইসলামের ভারতীয়করণ (Indianisation of Islam) ঘটে। সুফিরা মনে করতেন, ভারতবর্ষ হল তাঁদের স্বদেশ এবং ভারতবাসী তাঁদের আপনজন। তাঁরা এদেশে এসে এখানকার মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ক্রমে মুসলিম শাসকগোষ্ঠীও সুফিবাদের এই আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। 

(7) রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রভাব: সুফিবাদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল মধ্যযুগীয় ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থাও। বহু শাসক ও অভিজাত এই পর্বে সুফিদের সংস্পর্শে এসে অনুভব করেছিলেন, ধর্মীয় সহনশীলতা ব্যতীত রাজনৈতিক ঐক্য অসম্ভব।

(8) সামাজিক সচলতা: মধ্যযুগের সুলতানি শাসনে সামাজিক সচলতার উপাদান হিসেবে সুফিদর্শনের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। সুফিদর্শনের সাম্যভাবনা সমাজের নিম্নস্তরের মানুষকে উচ্চস্তরে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল। অস্পৃশ্য হিসেবে সমাজের অপাংক্তেয় মানুষ সুফিসাধকদের শিষ্যত্ব গ্রহণের পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধাভাজনে পরিণত হয়েছিলেন। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের রক্ষণশীল বর্ণ বা জাতিভিত্তিক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে এক বিপ্লব ছিল সুফিদর্শন। এই সামাজিক সচলতা পরবর্তী সময়ে মানবসম্পদের যথার্থ প্রয়োগের পথ দেখিয়েছিল।

আরও পড়ুন – নুন কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment