![]() |
হিন্দু মেলা টীকা লেখো
|
সূচনা
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত ‘চৈত্র মেলা’ বা ‘হিন্দুমেলা’ ভারতীয় জাতীয় জীবন এবং ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য স্থানের অধিকারী। ‘ন্যাশনাল’ নবগোপাল মিত্র (১৮৪০-৯৪ খ্রিঃ) ছিলেন এর প্রাণপুরুষ এবং তাঁর সহায়ক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, নাট্যকার মনোমোহন বসু, প্যারীচরণ সরকার, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, ভরতচন্দ্র শিরোমণি, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, অম্বিকাচরণ গৃহ প্রমুখ বাংলার বহু বিখ্যাত মানুষ।
পটভূমি
এই কালপর্বে বাংলায় বেশ কিছু রাজনৈতিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু এগুলির সঙ্গে দেশের নাড়ির যোগ স্থাপিত হয়নি। তারা দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থেই নিমগ্ন ছিল। এই অবস্থায় রাজনারায়ণ বসু শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবোধ বা জাতীয় গৌরববোধ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একটি সভা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তিনি বলেন যে, “জাতীয় গৌরবেচ্ছার উন্মেষণ ব্যতীত কোনো জাতি মহত্ব লাভ করিতে পারে না।” এই উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল চিৎপুরের রাজা নরসিংচন্দ্র বাহাদুরের বাগানে এক জাতীয় মেলার আয়োজন করা হয়। প্রথমে এর নাম হয় ‘জাতীয় মেলা’। এটি চৈত্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হত বলে পরে এর নাম হয় চৈত্র মেলা।
উদ্দেশ্য
এই মেলার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় জীবনের সকল দিককে সঞ্জীবিত করা। জাতীয় ঐক্যবোধ বৃদ্ধি, সামাজিক উন্নতি, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, স্বাস্থ্য-সব দিকে সর্বাঙ্গীন উন্নতি। এ সব কাজের দূরবর্তী লক্ষ ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জন। মেলার দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে সম্পাদক গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন যে, মেলার উদ্দেশ্য হল বছরের শেষে ‘হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা’। তিনি বলেন- “আমাদের এই মিলন সাধারণ ধর্মকর্মের জন্য নহে, কোনো বিষয় সুখের জন্য নহে, কোনো আমোদ-প্রমোদের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য-ভারতের জন্য।” তিনি বলেন যে, এর আরেকটি উদ্দেশ্য হল আত্মনির্ভরতা অর্জন-“যাহাতে এই আত্মনির্ভর ভারতবর্ষে স্থাপিত হয় -ভারতবর্ষে বন্ধমূল হয়, তাহা এই মেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য।”
‘হিন্দু মেলা’ নামকরণ ও গুরুত্ব
মেলার তৃতীয় বর্ষের কার্যবিবরণীতে একে ‘হিন্দু মেলা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই নামকরণের ফলে অনেকে এই সভাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।
- সেদিন ভারতবাসীর জাতীয় চেতনা অস্পষ্ট ছিল। তখন ‘হিন্দু’ ও ‘জাতীয়’ কথাটি ছিল সমার্থক ‘হিন্দু’ শব্দের সলো তখনও সাম্প্রদায়িকতার বিষ কোনোভাবেই জড়ায়নি। ব্রাহ্মসমাজ তখন নিজেদের হিন্দু বলে মনে করত এবং তারা প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যের পুনরুত্থান চেয়েছিল। দ্বিতীয় বর্ষের মেলার আয়োজন উপলক্ষে ‘ন্যাশনাল পেপার’ লেখে যে, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-পারসিক-সকল ধর্মমতের সমন্বয়ে তারা ভারতীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী।
- এই মেলা কোনো প্রাদেশিক গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তারা সারা ভারতের কথাই চিন্তা করত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “মিলে সবে ভারত-সন্তান” গান দিয়ে মেলার উদ্বোধন হত।
- হিন্দু মেলার প্রদর্শনীতে কৃষক, শিল্পী, গায়ক, মল্লযোদ্ধা, লাঠিয়াল, কুম্ভকার, স্বর্ণকার, তাঁতী, কামার, সূচিশিল্পী, উদ্যান-পালক, নারী-পুরুষ সকলে সমবেত হত। এইভাবে জাতীয় আন্দোলনের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
- হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গান, কবিতা ও প্রবন্ধ রচিত হয়। বালক রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার বিকাশ এখানেই শুরু হয়। স্বদেশি আন্দোলনের পূর্বে আর কোনো আন্দোলন বাংলা সাহিত্যকে এভাবে সঞ্জীবিত করেনি।
- কলকাতার অনুকরণে বাবুইপুর, দিনাজপুর, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও এই মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।